ভূমিকা:
কলকাতার প্রতিটি রাস্তারই নিজস্ব এক গল্প আছে, এক অনবদ্য ইতিহাস আছে। তেমনই এক রাস্তা হলো বিধান সরণি, যা কলকাতার উত্তর প্রান্তের এক প্রাণবন্ত ধমনী। একসময় যা ‘কর্নওয়ালিস স্ট্রিট’ নামে পরিচিত ছিল, কালের যাত্রায় আজ তা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, আধুনিক বাংলার রূপকার ড. বিধানচন্দ্র রায়ের স্মৃতি বহন করে। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় থেকে শুরু হয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড ক্রসিং পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাস্তাটি শুধু একটি যাতায়াতের পথ নয়, এটি যেন সময়ের এক জীবন্ত দলিল। ইতিহাসের পরত আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় মোড়া এই সরণিটি কলকাতা শহরের আত্মাকে ধারণ করে আছে। চলুন, এই রাস্তার অলিগলিতে ডুব দেওয়া যাক আর এর প্রাণবন্ত জীবনের স্বাদ নেওয়া যাক।
ঐতিহ্যের পদধ্বনি: বিধান সরণির ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বিধান সরণির ইতিহাস ১৭৪২ সাল থেকে শুরু, যখন মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে কলকাতাকে রক্ষা করতে তিন মাইল দীর্ঘ ‘মারাঠা খাত’ খনন করা হয়েছিল। যদিও মারাঠারা কখনও কলকাতা আক্রমণ করেনি, এই খাতই পরে ১৭৯৯ সালে বুজিয়ে ‘সার্কুলার রোড’ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এই রাস্তা পাকা করা হয় এবং তৎকালীন কলকাতা শহরের অন্যতম প্রধান রাস্তা হিসেবে এটি পরিচিতি লাভ করে। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট নামে পরিচিত এই পথে পা পড়েছে কত জ্ঞানী-গুণী মানুষের। শ্রীরামকৃষ্ণ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, এমনকি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্বদের পদধূলিতে ধন্য এই রাস্তা। এই পথেই রয়েছে বহু শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান।

শিক্ষার আলোকবর্তিকা: জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র
বিধান সরণি কেবল একটি বাণিজ্যিক বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নয়, এটি দীর্ঘকাল ধরে জ্ঞানচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। এখানে অবস্থিত একাধিক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর পরিচয়কে আরও উজ্জ্বল করেছে।
-
বেথুন কলেজ: নারীশিক্ষার পথপ্রদর্শক
হেদুয়ার কাছেই অবস্থিত বেথুন কলেজ, যা নারীশিক্ষার ইতিহাসে এক মাইলফলক। ১৮৪৯ সালে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ। আজও এই কলেজ হাজার হাজার ছাত্রীর ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
-
বিদ্যাসাগর কলেজ: আধুনিক শিক্ষার পথিকৃৎ
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছেই রয়েছে বিদ্যাসাগর কলেজ, যা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দূরদর্শিতার ফসল। এটি ভারতীয়দের অর্থে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা আধুনিক শিক্ষায় বিশ্বাসী ছিল। আজও এই কলেজ ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলেছে।
-
স্কটিশ চার্চ কলেজ: ঐতিহ্যের ধারক
কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এবং সম্মানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম হলো স্কটিশ চার্চ কলেজ। বহু কৃতি ছাত্র-ছাত্রী এই কলেজের প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। এমনকি, বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসুকেও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
-
স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক নিবাস
সিমলা পাড়ার বিখ্যাত দত্ত বাড়িতে ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন রামকৃষ্ণ মিশন স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক নিবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রূপে জনসাধারণের জন্য খোলা আছে। এটি শুধুমাত্র একটি জাদুঘর নয়, এটি একটি জীবন্ত কেন্দ্র যেখানে স্বামীজির জীবন ও দর্শন সম্পর্কে জানা যায়।

বিনোদন ও বাণিজ্যের স্পন্দন: সদা জাগ্রত বিধান সরণি
বিধান সরণি তার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পাশাপাশি বিনোদন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রাস্তা বরাবর আপনি খুঁজে পাবেন কলকাতার পুরনো ঐতিহ্যবাহী দোকানপাট এবং আধুনিক জীবনযাত্রার ছোঁয়া।
-
স্টার থিয়েটার: নাটকের আঙিনা
একসময় বিধান সরণির অন্যতম আকর্ষণ ছিল স্টার থিয়েটার। শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে এই মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে অজস্র বাংলা নাটক, যেখানে বিনোদিনী দাসীর মতো কিংবদন্তি অভিনেত্রীরা তাঁদের প্রতিভা দেখিয়েছেন। যদিও ১৯৯১ সালের অগ্নিকাণ্ডে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পুনর্নির্মাণের পরেও তার হারানো গৌরব পুরোপুরি ফিরে পায়নি, তবুও এটি কলকাতার নাট্য ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
-
সিনেমা হল: বিনোদনের কেন্দ্র
বিধান সরণির ধারে রয়েছে রাধা, রূপবাণী, মিনার, মিত্রা এবং দর্পণা – এই পাঁচটি সিনেমা হল। এই কারণে এই এলাকাটি কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। আজও মানুষ এখানে সিনেমা দেখতে ভিড় করে।
-
হাতিবাগান বাজার: কেনাকাটার ঠিকানা
বিধান সরণির পাশেই অবস্থিত bustling হাতিবাগান বাজার। পোশাক থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সবকিছুই এখানে পাওয়া যায়। এই বাজারের নিজস্ব এক আকর্ষণ রয়েছে, যেখানে কেনাকাটা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেয়।
-
মিষ্টান্ন ও খাবারের দোকান: স্বাদের ভ্রমণ
কলকাতার খাদ্যপ্রেমীদের কাছে বিধান সরণি এক বিশেষ স্থান। গিরিশচন্দ্র দে ও নকুরচন্দ্র নন্দীর মতো বিখ্যাত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারগুলি এখানে রয়েছে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মিষ্টির স্বাদ পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় খাবারের দোকান, যেখানে আপনি ফাস্ট ফুড থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাঙালি পদ উপভোগ করতে পারবেন। আরসালানের মতো জনপ্রিয় রেস্তোরাঁও এর আশেপাশে রয়েছে, যেখানে বিরিয়ানির স্বাদ নিতে বহু মানুষ আসেন।

বিধান সরণির কিছু বিখ্যাত স্থান ও তাদের বিশেষত্ব
| স্থানের নাম | বিশেষত্ব | প্রতিষ্ঠা / পরিচিতি |
|---|---|---|
| বেথুন কলেজ | ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ | ১৮৪৯ সাল |
| বিদ্যাসাগর কলেজ | ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, ভারতীয়দের অর্থে পরিচালিত প্রথম কলেজ | ১৮৭২ সাল |
| স্কটিশ চার্চ কলেজ | কলকাতার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ১৮৩০ সাল |
| রামকৃষ্ণ মিশন স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক নিবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র | স্বামী বিবেকানন্দের জন্মস্থান, বর্তমানে জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র | ২০০৪ সালে জনসাধারণের জন্য খোলা হয় (১৯৯৯ সালে অধিগ্রহণ ও সংস্কার) |
| ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি | কলকাতার অন্যতম প্রাচীন ও জাগ্রত কালীমন্দির | ১৬১০ বঙ্গাব্দে (আনুমানিক ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দ) |
| স্টার থিয়েটার | একসময়ের বিখ্যাত নাট্যমঞ্চ ও বিনোদন কেন্দ্র | ১৮৮৩ সাল |
| গিরিশচন্দ্র দে ও নকুরচন্দ্র নন্দী | ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার | ১৮৪৪ সাল |
আধুনিকতা ও পরিবর্তনের ঢেউ
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিধান সরণিও পরিবর্তিত হচ্ছে। পুরনো স্থাপত্যের পাশে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে নতুন বহুতল, আধুনিক দোকানপাট। কিন্তু এই পরিবর্তন সরণির মূল চরিত্রকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। আজও সকালে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে এই রাস্তা কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে, ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনায় মুখরিত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি, আর সন্ধ্যায় আলোর রোশনাইতে সেজে ওঠে এখানকার দোকানপাট ও বিনোদন কেন্দ্রগুলি। কলকাতার উত্তরের এক ব্যস্ততম ধমনী হিসাবে এটি তার নিজস্ব পরিচয় ধরে রেখেছে। এখানকার ট্রামের ঘন্টি আর মানুষের কোলাহল যেন কলকাতার এক নিজস্ব ছন্দ তুলে ধরে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
বিধান সরণির পুরনো নাম কি ছিল?
বিধান সরণির পুরনো নাম ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিট।
বিধান সরণি কার নামে নামকরণ করা হয়েছে?
পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের নামে এই রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে।
বিধান সরণির আশেপাশে কিছু বিখ্যাত খাবারের দোকানের নাম বলতে পারবেন?
হ্যাঁ, বিধান সরণি এবং তার আশেপাশে গিরিশচন্দ্র দে ও নকুরচন্দ্র নন্দীর মতো ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার রয়েছে। এছাড়াও, বিরিয়ানির জন্য আরসালান রেস্তোরাঁ nearby হাতিবাগানে অবস্থিত। অনেক ছোট ছোট ফাস্ট ফুড এবং বাঙালি খাবারের দোকানও রয়েছে।
উপসংহার:
বিধান সরণি শুধু একটি রাস্তা নয়, এটি কলকাতার উত্তর দিকের এক চলমান ইতিহাস, এক জীবন্ত সংস্কৃতি আর আধুনিকতার এক দারুণ মেলবন্ধন। এর প্রতিটি বাঁকে রয়েছে গল্প, প্রতিটি ধুলিকণায় মিশে আছে স্মৃতি। যারা কলকাতার আসল স্বাদ পেতে চান, ঐতিহ্যের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া খুঁজতে চান, তাদের জন্য বিধান সরণি এক অনবদ্য গন্তব্য। এখানে এলে আপনি কেবল একটি রাস্তা দেখবেন না, আপনি অনুভব করবেন কলকাতার স্পন্দন, কলকাতার আত্মা।