কলকাতার বুকে সবুজের এক বিশাল সাম্রাজ্য, যেখানে বন্যপ্রাণীদের দেখা মেলে খুব কাছ থেকে – সেটাই হলো আমাদের সকলের প্রিয় আলিপুর চিড়িয়াখানা! এই চিড়িয়াখানা শুধু একটি বিনোদন কেন্দ্র নয়, এটি প্রকৃতির এক অন্য জগৎ, যেখানে ছোট থেকে বড় সকলের মন ভরে ওঠে অনাবিল আনন্দে। প্রায় দেড় শতাব্দীর ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই চিড়িয়াখানা ভারতের প্রাচীনতম এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিড়িয়াখানাগুলোর মধ্যে একটি।
শহরের কোলাহল থেকে দূরে, সবুজে ঘেরা এই বিশাল প্রাঙ্গণটি প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে আকর্ষণ করে। এখানে এসে একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি দেখে সময় কাটানো যায়, তেমনই তাদের জীবনযাপন ও সংরক্ষণ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা যায়। চলুন, আলিপুর চিড়িয়াখানার এই প্রকৃতির অন্য জগতে একটু ডুব দেওয়া যাক!
আলিপুর চিড়িয়াখানার ইতিহাস: দেড় শতাব্দীর ঐতিহ্য
আলিপুর চিড়িয়াখানা শুধু বর্তমানের নয়, এটি ইতিহাসেরও একটি অংশ। ১৮৭৫ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর এর ভিত্তি স্থাপন করা হয় এবং পরের বছর, ১৮৭৬ সালের ১লা জানুয়ারি তৎকালীন প্রিন্স অফ ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। সেই সময় থেকেই এটি কলকাতার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। প্রথম দিকে ব্যারাকপুরের লাটবাগানের পুরনো চিড়িয়াখানা এবং কার্ল লুইসের ব্যক্তিগত পশু উদ্যান থেকে পশুপাখি এনে এই চিড়িয়াখানা শুরু হয়েছিল। ভারতীয় ও ব্রিটিশ অভিজাতদের আর্থিক সাহায্যে এবং দানে এটি ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করে।
এই চিড়িয়াখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক কিংবদন্তী কচ্ছপের গল্প – যার নাম অদ্বৈত। এটি ছিল একটি অ্যালডাব্রা দৈত্যাকার কচ্ছপ, যা রবার্ট ক্লাইভের পোষ্য ছিল বলে মনে করা হয়। ১৮৭৫ সালে এটি আলিপুর চিড়িয়াখানায় আসে এবং ২০০৬ সালে প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি বয়সে মারা যায়। অদ্বৈত শুধুমাত্র চিড়িয়াখানার নয়, বিশ্বের প্রবীণতম প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম ছিল। দীর্ঘ বছর ধরে এটি ছিল আলিপুর চিড়িয়াখানার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সময়ের সাথে সাথে চিড়িয়াখানার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আধুনিকীকরণ হয়েছে এবং প্রাণী সংরক্ষণে এর ভূমিকাও বেড়েছে। বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গ জু অথরিটি দ্বারা পরিচালিত হয় এবং প্রাণী সংরক্ষণের বিভিন্ন প্রকল্পে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
প্রাণীবৈচিত্র্যের এক অপূর্ব সমাহার
আলিপুর চিড়িয়াখানায় রয়েছে ১০০টিরও বেশি প্রজাতির প্রাণী, যা জীববৈচিত্র্যের এক অসাধারণ উদাহরণ। এখানে এসে আপনি দেখতে পাবেন বিভিন্ন দেশের এবং অঞ্চলের অদ্ভুত ও সুন্দর সব পশুপাখি। বাঘ, সিংহ, গন্ডার, হাতি, জাগুয়ার, জিরাফ, জেব্রা, শিম্পাঞ্জি, জলহস্তী, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, কুমীর এবং আরও অনেক কিছু এখানে বাস করে। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব খাঁচা বা ঘেরা জায়গায় তারা সুরক্ষিত পরিবেশে থাকে।
বন্যপ্রাণীর দুনিয়ায় এক ঝলক
চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুবিশাল খাঁচায় তাদের গমগমে উপস্থিতি আর রাজকীয় চলাফেরা মন মুগ্ধ করে তোলে। এছাড়া, সিংহের গর্জন, গন্ডারের ধীর পদচারণা, জিরাফের উঁচু গলা আর জেব্রার ডোরাকাটা সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। বাচ্চাদের জন্য শিম্পাঞ্জিদের দুষ্টুমি এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা এনে দেয়।

সরীসৃপ প্রেমীদের জন্য রয়েছে সাপের বাড়ি এবং কুমীর ও ঘড়িয়ালের জলাশয়। এখানে বিভিন্ন ধরনের সাপ এবং বিশাল আকারের কুমীরদের দেখে শরীর শিউরে ওঠে। এছাড়াও, পাখির জন্য রয়েছে আলাদা বিভাগ যেখানে দেশি-বিদেশি নানা রঙের পাখি আপন মনে উড়ে বেড়ায়। ময়ূর, টিয়া, রাজহাঁস, ফ্লেমিঙ্গো এবং উটপাখি – এমন অনেক পাখি আপনার মন জয় করবে।
নতুন আকর্ষণ: ওয়াক-ইন অ্যাভিয়ারি
আলিপুর চিড়িয়াখানার ১৫০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য এক নতুন এবং রোমাঞ্চকর আকর্ষণ সংযোজিত হয়েছে – তা হলো কাচে ঘেরা ওপেন-এয়ার ওয়াক-ইন অ্যাভিয়ারি। এটি ভারতের প্রথম এই ধরনের অ্যাভিয়ারি, যেখানে দর্শনার্থীরা কাচের করিডরের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে পাখিদের প্রাকৃতিক পরিবেশে খুব কাছ থেকে দেখতে পান।
এখানে পাখি খাঁচার ভিতরে নয়, বরং পাখিরা মুক্তভাবে উড়ে বেড়ায় এবং মানুষ থাকে কাচের ঘেরাটোপের মধ্যে। ময়ূর, লাভবার্ড, ককাটিয়েলসহ নানা প্রজাতির পাখি এখানে তাদের নিজস্ব ছন্দে জীবনযাপন করে। এই অভিনব উদ্যোগটি দর্শকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে, যেখানে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার এক ভিন্ন সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাখিদের অবাধ বিচরণ দেখে আপনি নিশ্চিতভাবেই মুগ্ধ হবেন।
আপনার ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য
আলিপুর চিড়িয়াখানা ভ্রমণের পরিকল্পনা করার আগে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া ভালো, যা আপনার ভ্রমণকে আরও সহজ ও আনন্দময় করে তুলবে।
টিকিট মূল্য ও সময়সূচী
চিড়িয়াখানা সাধারণত বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। তবে ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ থেকে জানুয়ারীর ৩১ তারিখ পর্যন্ত এটি প্রতিদিন খোলা থাকে।
| বিবরণ | সময় / মূল্য |
|---|---|
| খোলার সময় | সকাল ৯:০০ টা |
| বন্ধের সময় | সন্ধ্যা ৫:০০ টা |
| টিকিট কাউন্টার বন্ধের সময় | বিকাল ৪:৩০ টা |
| প্রাপ্তবয়স্কদের টিকিট | ৫০ টাকা |
| শিশুদের টিকিট (৫ বছরের নিচে) | ২০ টাকা |
| বন্ধের দিন | বৃহস্পতিবার (১৫ই ডিসেম্বর থেকে ৩১শে জানুয়ারী ছাড়া) |
অনলাইনেও টিকিট কাটার সুবিধা আছে, যা লম্বা লাইন এড়াতে সাহায্য করে।
কীভাবে পৌঁছাবেন
আলিপুর চিড়িয়াখানা কলকাতার কেন্দ্রে অবস্থিত এবং খুব সহজেই এখানে পৌঁছানো যায়।
- বাসে: কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সরাসরি আলিপুর চিড়িয়াখানার বাস পাওয়া যায়। এটি ২, আলিপুর রোড, আলিপুর জুলজিক্যাল গার্ডেন, আলিপুর, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ৭০০২২৭ ঠিকানায় অবস্থিত।
- মেট্রো: রবীন্দ্র সদন বা নেতাজী ভবন মেট্রো স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি নিয়ে চিড়িয়াখানায় পৌঁছানো যায়।
- ট্যাক্সি/ক্যাব: শহরের যেকোনো জায়গা থেকে সহজেই ট্যাক্সি বা ওলা/উবের বুক করে যাওয়া যাবে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- ভ্রমণের সেরা সময়: শীতকাল, অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস আলিপুর চিড়িয়াখানা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং পশুপাখিদেরও সক্রিয় দেখা যায়।
- খাবার: চিড়িয়াখানার ভিতরে খাবার নিয়ে প্রবেশ করা যায়, তবে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার না করাই ভালো। ভিতরে ছোটখাটো খাবারের দোকানও রয়েছে।
- জল: পর্যাপ্ত জল নিয়ে যান, কারণ অনেকটা হাঁটতে হতে পারে।
- জুতা: আরামদায়ক জুতা পরিধান করুন, কারণ চিড়িয়াখানার আয়তন বেশ বড়।
- ক্যামেরা: পশুপাখিদের ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা নিতে ভুলবেন না! তবে ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করাই ভালো।

FAQs – আপনার জিজ্ঞাস্য
আলিপুর চিড়িয়াখানা কবে বন্ধ থাকে?
সাধারণত আলিপুর চিড়িয়াখানা প্রতি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। তবে, শীতকালীন মরসুমে, অর্থাৎ ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ৩১শে জানুয়ারী পর্যন্ত চিড়িয়াখানা প্রতিদিন খোলা থাকে এবং কোনো সাপ্তাহিক ছুটি থাকে না।
চিড়িয়াখানায় কি খাবার নিয়ে যাওয়া যায়?
হ্যাঁ, আলিপুর চিড়িয়াখানার ভিতরে খাবার নিয়ে যাওয়া যায়। তবে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার না করার অনুরোধ জানানো হয়। চিড়িয়াখানার ভিতরে কিছু খাবারের স্টলও আছে।
আলিপুর চিড়িয়াখানার আশেপাশে আর কী কী ঘোরার জায়গা আছে?
আলিপুর চিড়িয়াখানার আশেপাশে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ন্যাশনাল লাইব্রেরি, যা ভারতের বৃহত্তম গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে একটি। এছাড়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এবং সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল খুব বেশি দূরে নয়, যেখানে আপনি কলকাতার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও স্থাপত্যের সাক্ষী হতে পারবেন।
আলিপুর চিড়িয়াখানা শুধুমাত্র একটি চিড়িয়াখানা নয়, এটি প্রকৃতির এক চলমান পাঠশালা, যেখানে প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি মুহূর্তই যেন এক নতুন গল্প বলে যায়। শহর জীবনের ব্যস্ততার মাঝে এটি এক শান্তির আশ্রয়, যেখানে আমরা প্রকৃতির সাথে আবার নতুন করে যুক্ত হতে পারি। সুতরাং, আপনার পরবর্তী কলকাতা ভ্রমণে আলিপুর চিড়িয়াখানা ঘুরে আসতে ভুলবেন না!