ন্যাশনাল লাইব্রেরি: জ্ঞান অন্বেষণের এক অমূল্য ভান্ডার
জ্ঞানের খোঁজে মানুষ যুগে যুগে বিভিন্ন পথে হেঁটেছে। আর এই অনন্ত জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। একটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, মেধা ও মননের ধারক ও বাহক হলো এর জাতীয় গ্রন্থাগার। ভারতে, কলকাতার আলোপুরের বেলভেডিয়ার এস্টেটে অবস্থিত ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া তেমনই একটি অনন্য পীঠস্থান, যা শুধুমাত্র বইয়ের সংগ্রহশালা নয়, বরং জ্ঞান অন্বেষণকারীদের জন্য এক বিশাল দরজা খুলে দিয়েছে।
এই গ্রন্থাগারটি ভারতের বৃহত্তম এবং এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ একটি লাইব্রেরি। এর সুবিশাল সংগ্রহ শুধু পাঠককেই মুগ্ধ করে না, বরং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং স্থাপত্যশৈলীও পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। চলুন, এই জ্ঞানভান্ডারের গভীরে ডুব দেওয়া যাক!

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: এক গৌরবময় যাত্রা
ভারতের ন্যাশনাল লাইব্রেরির ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ। এর সূচনা হয় ১৮৩৬ সালের ২১শে মার্চ ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে। এটি ছিল পূর্ব ভারতের প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি। সেই সময় সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর, এর প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই লাইব্রেরিটি জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং এটি স্ব-অর্থায়নে পরিচালিত হত।
১৯০২ সালে লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিকে তৎকালীন ইম্পেরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরির সাথে একীভূত করে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি গঠন করা হয়। ১৯০৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি মেটকাফ হলে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, যিনি ১৯১০ সালে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি কাউন্সিলের সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ৮০,০০০ বইয়ের বিশাল সংগ্রহ এই লাইব্রেরিকে দান করেন, যা এর সংগ্রহকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।
স্বাধীনতার পর, ১৯৪৮ সালে ‘ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি (নাম পরিবর্তন) আইন’ এর মাধ্যমে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির নাম পরিবর্তন করে ন্যাশনাল লাইব্রেরি রাখা হয়। অবশেষে, ১৯৫৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ভারতের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এটি জনসাধারণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করেন। এরপর ১৯৭৬ সালের ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ অনুযায়ী এর নাম পরিবর্তন করে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া’ রাখা হয়। বেলভেডিয়ার এস্টেটের মনোরম পরিবেশে অবস্থিত এই লাইব্রেরিটি বর্তমানে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়।
অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া শুধুমাত্র একটি বিশাল ভবন নয়, এটি জ্ঞানের এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। এর সংগ্রহ এতটাই বিশাল যে আপনি কল্পনার বাইরে চলে যাবেন। এখানে প্রায় ২২ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশি বই, ৮৬,০০০ মানচিত্র এবং ৩,২০০-এর বেশি পাণ্ডুলিপি রয়েছে। শেল্ফের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৫ কিলোমিটার, যা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো!
- বিভিন্ন ভাষার বই: শুধুমাত্র ইংরেজি বা হিন্দি নয়, এখানে বাংলা, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, কাশ্মীরি, মালয়ালম, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সিন্ধি, তামিল, তেলুগু এবং উর্দু সহ ভারতের প্রায় সমস্ত প্রধান ভাষার বই, সাময়িকী ও সংবাদপত্র পাওয়া যায়। এমনকি কিছু বিরল পালি ও প্রাকৃত পাণ্ডুলিপিও এখানে সংরক্ষিত আছে।
- দুর্লভ সংগ্রহ: এই লাইব্রেরিতে ১৯ শতকের ভারতীয় বই, ১৯০০ সালের আগে প্রকাশিত ইংরেজি বই এবং অসংখ্য দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, যা গবেষকদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ভারতের সমস্ত সরকারি নথিও এখানে যত্ন সহকারে রাখা হয়েছে।
- আইনগত বাধ্যবাধকতা: ‘দ্য ডেলিভারি অফ বুকস অ্যান্ড নিউজপেপারস (পাবলিক লাইব্রেরিজ) অ্যাক্ট, ১৯৫৪’ অনুসারে, ভারতের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রকাশিত প্রতিটি বইয়ের একটি কপি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর ফলে এটি দেশের সমস্ত প্রকাশিত সাহিত্য সংরক্ষণের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

সুযোগ-সুবিধা এবং ব্যবহারিক তথ্য
ন্যাশনাল লাইব্রেরি শুধুমাত্র গবেষকদের জন্য নয়, সাধারণ পাঠক, ছাত্রছাত্রী এবং শিশুদের জন্যও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এর বিশাল রিডিং রুমগুলোতে একসাথে প্রায় ৫৫০ জন পাঠক বসে পড়াশোনা করতে পারেন।
পরিদর্শনের সময়সূচী ও প্রবেশাধিকার
| দিন | সময় | প্রবেশাধিকার |
|---|---|---|
| সোমবার – শুক্রবার (কার্যদিবস) | সকাল ৮:০০ – রাত ৮:০০ | সদস্য কার্ডধারীদের জন্য (১৮+ বছর) |
| শনিবার, রবিবার ও সরকারি ছুটি | সকাল ৯:৩০ – সন্ধ্যা ৬:০০ | সদস্য কার্ডধারীদের জন্য (১৮+ বছর) |
| শিশুদের লাইব্রেরি (চিলড্রেনস লাইব্রেরি) | সকাল ৯:০০ – সন্ধ্যা ৬:০০ (সপ্তাহের সব দিন) | ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য (বিনামূল্যে) |
| বন্ধ থাকে | স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ও অন্যান্য বিশেষ সরকারি ছুটি | সম্পূর্ণ বন্ধ |
এখানে প্রবেশ ফি লাগে না, তবে রিডিং রুম ব্যবহারের জন্য একটি সদস্যতা কার্ড প্রয়োজন। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো ব্যক্তি পরিচয়পত্র দেখিয়ে সদস্য কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন। পর্যটক এবং যারা একদিনের জন্য লাইব্রেরি ব্যবহার করতে চান, তাদের জন্য অস্থায়ী কার্ডের ব্যবস্থা আছে।
আধুনিক সুযোগ-সুবিধা
- ই-রিসোর্স সেন্টার: এখানে ৫০টি কম্পিউটার সহ একটি ই-রিসোর্স সেন্টার রয়েছে, যেখানে পাঠক ও গবেষকরা ই-বুক, ই-জার্নাল এবং লাইব্রেরির ডিজিটাইজড ডেটাবেস ব্যবহার করতে পারেন।
- ডিজিটাইজেশন প্রকল্প: লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ দুর্লভ বই ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য ডিজিটাইজেশন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। হাজার হাজার পুরাতন ও ভঙ্গুর বই স্ক্যান করে ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
- শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য: হুইলচেয়ার প্রবেশযোগ্য পার্কিং, প্রবেশপথ এবং বসার ব্যবস্থা রয়েছে, যা এটিকে সকলের জন্য উপযোগী করে তুলেছে।
- পার্কিং: এখানে বিনামূল্যে পার্কিং-এর সুব্যবস্থা রয়েছে।
স্থাপত্যশৈলী ও পরিবেশ
কলকাতার এই জাতীয় গ্রন্থাগারটি শুধুমাত্র বইয়ের জন্য বিখ্যাত নয়, এর স্থাপত্যশৈলী এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশও মনোমুগ্ধকর। একটি সুপ্রাচীন ১৮ শতকের প্রাসাদে অবস্থিত এই লাইব্রেরি ভবনটি তার গ্রান্ডeur বজায় রেখেছে। এর লম্বা স্তম্ভ, খিলানযুক্ত প্রবেশপথ এবং সাদা রঙের বিপরীতে সবুজ দরজা-জানালা এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করে। বেলভেডিয়ার হাউস, যা ১৭০০ সালের দিকে আজিম-উস-শান নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেটিই এখন এই গ্রন্থাগারের প্রধান ভবন।
গ্রন্থাগারের চারপাশ সবুজের সমারোহে ঘেরা। এখানে একটি সুন্দর বাগানও রয়েছে, যা পাঠক এবং দর্শনার্থীদের জন্য এক নির্মল পরিবেশ তৈরি করে। পড়াশোনার পাশাপাশি মানুষ এখানে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারে।

এই শান্ত ও সুন্দর পরিবেশ কোলাহলপূর্ণ শহর কলকাতা থেকে এক অন্যরকম আশ্রয় দেয়।
জাতীয় গ্রন্থাগারের গুরুত্ব
একটি জাতীয় গ্রন্থাগার কেবল বইয়ের সংগ্রহশালা নয়, এটি একটি জাতির সম্মিলিত জ্ঞান ও ঐতিহ্যের স্মারক।
- সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ: এটি দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখে।
- গবেষণা ও শিক্ষা: গবেষক, পণ্ডিত এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অপরিহার্য তথ্য এবং রেফারেন্সের একটি প্রধান উৎস। এটি জ্ঞান উৎপাদন ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- তথ্য প্রবেশাধিকার: এটি দেশের সকল নাগরিককে তথ্যে প্রবেশাধিকার প্রদান করে, যা একটি শিক্ষিত ও তথ্য-ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক।
- জাতীয় গ্রন্থপঞ্জি নিয়ন্ত্রণ: এটি দেশের প্রকাশিত সমস্ত বইয়ের একটি তালিকা (জাতীয় গ্রন্থপঞ্জি) তৈরি ও সংরক্ষণ করে, যা প্রকাশনা শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: এটি আন্তর্জাতিক লাইব্রেরি সংস্থাগুলির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং বৈশ্বিক জ্ঞান বিনিময়ে অংশ নেয়।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া কোথায় অবস্থিত?
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার আলিপুরের বেলভেডিয়ার এস্টেটে অবস্থিত।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি পরিদর্শনের জন্য কোনো প্রবেশ ফি লাগে কি?
না, ন্যাশনাল লাইব্রেরি পরিদর্শনের জন্য কোনো প্রবেশ ফি লাগে না। তবে, রিডিং রুম বা অন্যান্য বিশেষ সুবিধা ব্যবহারের জন্য পরিচয়পত্র এবং একটি সদস্যতা কার্ডের প্রয়োজন হতে পারে।
লাইব্রেরিতে কতগুলি বই এবং অন্যান্য সংগ্রহ রয়েছে?
ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে প্রায় ২২ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশি বই, ৮৬,০০০ মানচিত্র এবং ৩,২০০-এর বেশি পাণ্ডুলিপি রয়েছে। এটি ভারতের বৃহত্তম এবং এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ লাইব্রেরি।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি কি শিশুদের জন্য উপযুক্ত?
হ্যাঁ, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য একটি ডেডিকেটেড চিলড্রেনস লাইব্রেরি রয়েছে, যেখানে তারা বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারে। এটি শিশুদের জ্ঞান অর্জনের জন্য একটি চমৎকার জায়গা।
উপসংহার
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া কেবল একটি ভবন বা বইয়ের সংগ্রহ নয়; এটি জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। এটি অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে যুক্ত করে এবং ভবিষ্যতের পথ দেখায়। যারা জ্ঞান অন্বেষণ করেন, তাদের জন্য এটি সত্যিই এক ‘জ্ঞান অর্জনের পীঠস্থান’। এখানকার শান্ত পরিবেশ, সুবিশাল সংগ্রহ এবং আধুনিক সুবিধাগুলি এটিকে পাঠক ও গবেষকদের জন্য এক আদর্শ স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আপনি যদি কখনও কলকাতায় যান, তবে এই বিশাল জ্ঞানভান্ডারটি একবার ঘুরে আসা আপনার জন্য এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে।