পদ্মনাভম প্যালেস: স্থাপত্য আর ইতিহাসের এক অনবদ্য মেলবন্ধন
যখন আমরা ‘পদ্মনাভম প্যালেস’ নামটি শুনি, তখন অনেকের মনেই কলকাতার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই অসাধারণ ঐতিহাসিক প্রাসাদটি আসলে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত নয়! এটি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী জেলার পাদমনাভপুরমে অবস্থিত, যদিও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কেরালার সরকার পালন করে থাকে। ত্রাভাঙ্কোর রাজ্যের প্রাচীন এই রাজধানী একসময় দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। এই কাঠের প্রাসাদটি কেরালার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং ভারতের ঐতিহ্যবাহী কাঠের স্থাপত্যের এক জীবন্ত জাদুঘর।
ইতিহাসের পাতায় পদ্মনাভম প্যালেস
পদ্মনাভম প্যালেসের ইতিহাস প্রায় ১৬শ শতাব্দীর। আনুমানিক ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে ইরবি বর্মা কুলশেখর পেরুমাল এই প্রাসাদের নির্মাণ শুরু করেন। পরবর্তীকালে, ত্রাভাঙ্কোরের প্রতিষ্ঠাতা, কিং অনিঝাম থিরুনাল মার্তান্ডা বর্মা ১৭৫০ সালের দিকে প্রাসাদটির পুনর্গঠন এবং সম্প্রসারণ করেন। তিনি তাঁর রাজ্যকে পারিবারিক দেবতা শ্রী পদ্মনাভের (ভগবান বিষ্ণুর এক রূপ) চরণে উৎসর্গ করেন এবং নিজেকে ‘পদ্মনাভ দাসা’ বা পদ্মনাভের সেবক হিসেবে ঘোষণা করেন। এই থেকেই স্থানটির নাম হয় পদ্মনাভপুরম, অর্থাৎ ‘পদ্মনাভের শহর’।
- প্রতিষ্ঠা: আনুমানিক ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে ইরবি বর্মা কুলশেখর পেরুমাল দ্বারা।
- পুনর্গঠন: ১৭৫০ সালের দিকে কিং অনিঝাম থিরুনাল মার্তান্ডা বর্মা দ্বারা।
- রাজধানী: ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত এটি ত্রাভাঙ্কোর রাজ্যের রাজধানী ছিল।
- গুরুত্ব: এরপর ১৭৯৫ সালে রাজধানী তিরুবনন্তপুরমে স্থানান্তরিত হয়, কিন্তু প্রাসাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে।

এই প্রাসাদ শুধুমাত্র একটি স্থাপত্য নয়, এটি সময়, সংস্কৃতি এবং রাজকীয় ঐতিহ্যের এক স্মারক। এর প্রতিটি ইঞ্চি যেন প্রাচীন ভারতের গল্প বলে।
কাঠের কারুকাজের এক বিস্ময়: কেরালা স্থাপত্যশৈলী
পদ্মনাভম প্যালেস তার অসাধারণ কাঠের কারুকাজের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এটি ভারতের প্রাচীনতম, বৃহত্তম এবং সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত কাঠের প্রাসাদ। কেরালা স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে এটি UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্ভাব্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই স্থাপত্যশৈলী ঐতিহ্যবাহী নির্মাণ প্রযুক্তি, সূক্ষ্ম কারুশিল্প এবং উন্নত বস্তু বিজ্ঞানের এক অনন্য মিশ্রণ।
প্রাসাদের প্রতিটি খুঁটিনাটি ‘তচ্চশাস্ত্র’ (কাঠের কাজ এবং স্থাপত্যের বিজ্ঞান) এর কঠোর নীতি মেনে তৈরি করা হয়েছে, যা কেবল নান্দনিকভাবে সুন্দর নয়, বরং প্রকৃতির সাথে নিখুঁতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভবনও তৈরি করেছে।
- কাঠের ব্যবহার: রোজউড, সেগুন কাঠ এবং কাঁঠাল কাঠের খিলান ও স্তম্ভ এর প্রধান আকর্ষণ।
- খোদাই শিল্প: জটিল কাঠের খোদাই এবং সর্পিল নকশাগুলি তৎকালীন কারিগরদের দক্ষতার পরিচয় দেয়।
- ছাদ: ছাদগুলিতে প্রাকৃতিক রঙে আঁকা ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীর ম্যুরালগুলি চোখ ধাঁধানো।
প্যালেসের অন্দরমহল: যেখানে ইতিহাস জীবন্ত
পদ্মনাভম প্যালেসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন সময় থেমে গেছে। প্রতিটি কক্ষ, প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে অসংখ্য গল্প।
মন্ত্রশালা (King’s Council Chamber)
এটি রাজার সভাকক্ষ ছিল, যেখানে রাজা তাঁর মন্ত্রীদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতেন। কক্ষটি তার বিশালতা এবং কাঠের সূক্ষ্ম কাজের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮২৯ থেকে ১৮৪৬ সালের মধ্যে এটি নির্মিত হয়।
থাই কোটারম (Queen Mother’s Palace)
এটি প্রাসাদের সবচেয়ে প্রাচীন অংশ, যা ১৫৫০ সালে নির্মিত হয়েছিল। কেরালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই কক্ষের সিলিংয়ে ৯০টিরও বেশি ভিন্ন ধরনের ফুলের মোটিফ আঁকা আছে। এর ভেতরের উঠোন, যাকে ‘নালুকেট্টু’ বলা হয়, এবং ছোট একটি চেম্বার ‘একান্ত মন্ডপম’ খুবই আকর্ষণীয়।
ওপরিক্কা মালিকা (King’s Bedchamber)
এই চারতলা ভবনটি মার্তান্ডা বর্মা ১৭৪৫ সালে নির্মাণ করেন। এর নিচতলায় রাজকীয় কোষাগার ছিল, যা মূল্যবান রত্ন এবং সম্পদ ধারণ করত। ওপরের তলাগুলিতে রাজার শয়নকক্ষ এবং উপাসনার জন্য বিশেষ কক্ষ ছিল। শয়নকক্ষের বিখ্যাত ‘সপ্রমনচা কাটিল’ বিছানাটি ৬৪ প্রকার ঔষধি গুণসম্পন্ন কাঠ দিয়ে তৈরি বলে কথিত আছে।

নাটকশালা (Performance Hall)
এটি সেই স্থান যেখানে রাজকীয় পরিবার বিভিন্ন শিল্প ও নাট্যানুষ্ঠান উপভোগ করত। এর স্থাপত্য এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন শব্দ প্রাসাদের প্রতিটি কোণে সমানভাবে পৌঁছায়।
মনি মেদা (Clock Tower)
প্রাসাদের মূল প্রবেশদ্বারের কাছে একটি বড় ঘড়ি সহ একটি ঘড়ি টাওয়ার রয়েছে, যা সূক্ষ্ম ফিলিগরি কাজের জন্য পরিচিত। এই ঘড়িটি প্রায় ৩০০ বছর ধরে কাজ করছে।
ভোজনশালা (Dining Hall)
প্যালেসের ভোজনশালাটি প্রায় ১০০০ জন মানুষকে একসাথে খাবার পরিবেশনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এটি তৎকালীন সময়ের রাজকীয় আয়োজনের প্রমাণ বহন করে।
পদ্মনাভম প্যালেসের কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য
পদ্মনাভম প্যালেসের প্রতিটি কোণায় কিছু না কিছু বিশেষত্ব রয়েছে যা দর্শকদের মুগ্ধ করে:
- বেলজিয়ান আয়না: প্রাসাদের অভ্যন্তরে শোভা পাচ্ছে প্রাচীন বেলজিয়ান আয়না, যা আলোর প্রতিফলনে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে।
- রঙিন মিকা জানালা: জানালার কাঁচগুলিতে রঙিন মিকা ব্যবহার করা হয়েছে, যা সূর্যালোকের সাথে সাথে ভিন্ন ভিন্ন রঙে ঝলমল করে।
- চীনা খোদাই: কিছু রাজকীয় চেয়ার এবং আসবাবে চীনা শৈলীতে খোদাই করা নকশা দেখা যায়, যা বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ইঙ্গিত দেয়।
- ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ: জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের অস্তিত্বও শোনা যায়, যা প্রাসাদের বাইরে চলে গেছে।
- ঐতিহ্যবাহী জল ব্যবস্থা: প্রাসাদে একটি উন্নত জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল, যা রান্নার জন্য এবং স্নানের জন্য জল সরবরাহ করত।

দর্শনার্থীদের জন্য তথ্য
আপনি যদি পদ্মনাভম প্যালেসের স্থাপত্য ও ইতিহাস উপভোগ করতে চান, তবে কিছু তথ্য জেনে রাখা ভালো:
| কক্ষের নাম | প্রধান বৈশিষ্ট্য | ঐতিহাসিক তাৎপর্য |
|---|---|---|
| থাই কোটারম | প্রাচীনতম অংশ, ৯০টির বেশি ফুলের মোটিফ | রানি মায়ের বাসস্থান |
| মন্ত্রশালা | বিশাল সভাকক্ষ | রাজা ও মন্ত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা |
| ওপরিক্কা মালিকা | চারতলা ভবন, রাজকীয় কোষাগার, রাজার শয়নকক্ষ | রাজকীয় বাসস্থান ও সম্পদ সংরক্ষণ |
| ভোজনশালা | ১০০০ জন মানুষের ধারণক্ষমতা | বৃহৎ রাজকীয় ভোজের আয়োজন |
- অবস্থান: কন্যাকুমারী জেলা, তামিলনাড়ু।
- খোলা থাকার সময়: সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২:৩০টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪:৩০টা।
- বন্ধ থাকে: প্রতি সোমবার এবং জাতীয় ছুটির দিনগুলিতে বন্ধ থাকে।
- প্রবেশের নিয়ম: প্রাসাদের ভেতরে জুতা পরা নিষেধ।
- রেটিং: গুগল ম্যাপে প্রায় ২২,০০০ রিভিউ এবং ৪.৪ রেটিং প্রাপ্ত।
সাধারণ জিজ্ঞাস্য (FAQs)
১. পদ্মনাভম প্যালেস কি কলকাতায় অবস্থিত?
না, পদ্মনাভম প্যালেস কলকাতায় অবস্থিত নয়। এটি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কন্যাকুমারী জেলার পদ্মনাভপুরমে অবস্থিত। যদিও কেরালার সরকার এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে।
২. এই প্রাসাদটি কিসের জন্য বিখ্যাত?
পদ্মনাভম প্যালেস মূলত তার ব্যতিক্রমী কেরালা স্থাপত্যশৈলী এবং সূক্ষ্ম কাঠের কারুকাজের জন্য বিখ্যাত। এটি ভারতের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম কাঠের প্রাসাদগুলির মধ্যে অন্যতম।
৩. পদ্মনাভম প্যালেসের প্রধান আকর্ষণগুলি কী কী?
এর প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে মন্ত্রশালা (রাজার সভাকক্ষ), থাই কোটারম (রানি মায়ের প্রাসাদ), ওপরিক্কা মালিকা (রাজার শয়নকক্ষ ও কোষাগার যেখানে ‘সপ্রমনচা কাটিল’ রয়েছে), নাটকশালা, ঘড়ি টাওয়ার এবং বিশাল ভোজনশালা। এছাড়াও এর কাঠের খোদাই, ম্যুরাল এবং বেলজিয়ান আয়নাগুলিও দর্শনীয়।
উপসংহার
পদ্মনাভম প্যালেস শুধুমাত্র একটি প্রাসাদ নয়, এটি ইতিহাস, শিল্প এবং সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। এটি দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্য ঐতিহ্যের এক অমূল্য রত্ন, যা প্রতিটি পর্যটককে তার সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক মহিমায় মুগ্ধ করে। তাই, আপনি যদি ইতিহাসের গভীরে ডুব দিতে এবং অনন্য স্থাপত্যশৈলীর অভিজ্ঞতা লাভ করতে চান, তবে পদ্মনাভম প্যালেস আপনার ভ্রমণ তালিকায় একটি অবিস্মরণীয় স্থান হতে পারে।