হাওড়া ব্রিজ: কলকাতার গৌরব, এক অনন্য স্থাপত্যের গাথা
কলকাতার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে ছবি, তার মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। হুগলি নদীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল সেতুটি শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি কলকাতা ও হাওড়ার হৃদস্পন্দন, ইতিহাস আর আধুনিকতার এক অনবদ্য মেলবন্ধন। সরকারিভাবে ‘রবীন্দ্র সেতু’ নামে পরিচিত হলেও, সবার মুখে মুখে এটি আজও হাওড়া ব্রিজ নামেই উজ্জ্বল। চলুন, এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের গভীরে ডুব দেওয়া যাক।
হাওড়া ব্রিজের জন্মকথা: ইতিহাসের পাতায়
হাওড়া ব্রিজের গল্প শুরু হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৮৫৫-৫৬ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন প্রথম হাওড়া ও কলকাতার মধ্যে একটি স্থায়ী সেতুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে সময় হুগলি নদীর দু’পাড়ে ব্রিটিশদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছিল দ্রুত গতিতে, গড়ে উঠছিল একের পর এক কলকারখানা। কিন্তু নদী পারাপারের একমাত্র ভরসা ছিল একটি নড়বড়ে পন্টুন ব্রিজ। এটি এতটাই দুর্বল ছিল যে স্টিমার বা জাহাজ এলেই মাঝখান থেকে খুলে দিতে হতো, যার ফলে যানজট সৃষ্টি হতো।
১৮৭১ সালে ‘হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’ পাস হওয়ার পর স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলিকে প্রথম পন্টুন ব্রিজ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ভাসমান সেতুটি ১৮৭৪ সালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এটি প্রায় ৪৬৫.৭ মিটার লম্বা এবং ১৯ মিটার চওড়া ছিল, যার দু’পাশে ২.১ মিটার চওড়া ফুটপাত ছিল। তবে ১৮৭৪ সালের এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে একটি স্টিমারের ধাক্কায় সেতুর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও মেরামত করে এটিকে পুনরায় চালু করা হয়, কিন্তু ক্রমবর্ধমান যানজট এবং নদীর বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একটি আরও শক্তিশালী সেতুর প্রয়োজন ছিল।
নতুন সেতুর স্বপ্ন ও বাস্তবায়ন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে নতুন সেতুর পরিকল্পনা সাময়িকভাবে স্থগিত থাকলেও, ১৯২১ সালে স্যার আর. এন. মুখার্জির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় নতুন হাওড়া ব্রিজ নির্মাণের জন্য। এরপর অনেক আলোচনা ও নকশার পর ১৯২৬ সালে ‘নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’ পাস হয়। ক্লিভল্যান্ড ব্রিজ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে নতুন সেতু তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ১৯৩৬ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও কাজ দ্রুত গতিতে চলে। এই সেতু তৈরিতে প্রায় ২৬,৫০০ টন ইস্পাত ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে ২৩,০০০ টন উচ্চ-টানযুক্ত ইস্পাত (যা ‘টিসক্রোম’ নামে পরিচিত) সরবরাহ করেছিল টাটা স্টিল। এটি সম্ভবত ভারতের প্রথম ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প ছিল। ছয় বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৯৪২ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ১৯৪৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এই অসাধারণ সেতুটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেই সময় এটি বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার সেতু ছিল।

অদ্বিতীয় নির্মাণশৈলী: নাট-বোল্ট ছাড়াই এক বিস্ময়
হাওড়া ব্রিজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর নির্মাণশৈলী। এটি একটি ক্যান্টিলিভার সেতু, যার মানে হলো নদীর মাঝখানে কোনো পিলার ছাড়াই এটি দুই পাড়ের স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই পুরো সেতুটি নির্মাণে একটিও নাট-বোল্ট ব্যবহার করা হয়নি। পরিবর্তে, প্রতিটি ইস্পাতের অংশকে রিভেট করে জোড়া লাগানো হয়েছে, যা এর দৃঢ়তা এবং দীর্ঘস্থায়ীত্বের এক জ্বলন্ত প্রমাণ। এটি সেই সময়ের প্রকৌশলীদের মেধা ও দূরদর্শিতার এক বিরল দৃষ্টান্ত।
সেতুটির প্রধান স্তম্ভগুলো এতটাই শক্তিশালী যে, একে ভূমিকম্প প্রতিরোধী করেও তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ৮৫ মিটার উঁচু এই প্রধান স্তম্ভগুলো পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম একক মনোলিথিক ক্যাসনের ওপর স্থাপিত। মজার বিষয় হলো, তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে হাওড়া ব্রিজ দিনে প্রায় ৪.৮ ইঞ্চি পর্যন্ত প্রসারিত হয় এবং রাতে আবার সঙ্কুচিত হয়। এই ধরনের নকশা নিশ্চিত করে যে সেতুটি আবহাওয়ার বিভিন্ন পরিস্থিতিতেও অটুট থাকে।
হুগলি নদীর উপর জীবনের স্পন্দন
হাওড়া ব্রিজ শুধুমাত্র দুটি শহরকে সংযুক্ত করে না, এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিন এই সেতুর উপর দিয়ে প্রায় ১ লক্ষেরও বেশি যানবাহন এবং ১.৫ লক্ষেরও বেশি পথচারী চলাচল করে, যা এটিকে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ক্যান্টিলিভার সেতুতে পরিণত করেছে। কলকাতার প্রবেশদ্বার হিসেবে এটি হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনের সাথে শহরকে সংযুক্ত করে, যা ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে হাব।
সেতুটির দু’পাশে প্রায় ৪.৬ মিটার চওড়া ফুটপাত রয়েছে, যা পথচারীদের জন্য নিরাপদ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই সেতুতে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। সকালে যখন সূর্যের প্রথম আলো সেতুর উপর পড়ে, তখন এক ভিন্ন দৃশ্য। আবার রাতে যখন আলো ঝলমলে কলকাতা ও হুগলি নদী সেতুর নিচে ঝিকমিক করে, তখন তার সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়।

হাওড়া ব্রিজের কিছু দ্রুত তথ্য
| বৈশিষ্ট্য | তথ্য |
|---|---|
| সরকারি নাম | রবীন্দ্র সেতু |
| উদ্বোধন | ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩ |
| প্রকার | ব্যালান্সড ক্যান্টিলিভার ব্রিজ |
| মোট দৈর্ঘ্য | ৭০৫ মিটার (২৩১৩ ফুট) |
| মোট প্রস্থ | ২১.৬ মিটার (৭১ ফুট) |
| ফুটপাতের প্রস্থ (প্রতিটি) | ৪.৬ মিটার (১৫ ফুট) |
| প্রধান স্প্যান | ৪৬০ মিটার (১৫০০ ফুট) |
| ব্যবহৃত ইস্পাত | ২৬,৫০০ টন (যার মধ্যে ২৩,০০০ টন টিসক্রোম) |
| নির্মাণ খরচ | প্রায় ২৫ মিলিয়ন রুপি |
| দৈনিক যান চলাচল | ১ লক্ষের বেশি |
| দৈনিক পথচারী | ১.৫ লক্ষের বেশি |
| উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য | নাট-বোল্ট ছাড়া রিভেট দ্বারা নির্মিত |
হাওড়া ব্রিজ: আধুনিক যুগেও প্রাসঙ্গিক
৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিষেবা দিয়ে আসা হাওড়া ব্রিজ আজও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও এর গুরুত্ব বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং, এটি কলকাতার একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এর স্থাপত্যশৈলী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব এটিকে পশ্চিমবঙ্গের এক অমূল্য সম্পদ করে তুলেছে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে, প্রায় ৪০ বছর পর, হাওড়া ব্রিজের প্রথম স্বাস্থ্য নিরীক্ষা করা হয়। এই নিরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল সেতুটির বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করা এবং এর দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। এই ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ প্রমাণ করে যে এই ঐতিহাসিক সেতুটিকে আগামী প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখতে কতটা যত্ন নেওয়া হচ্ছে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
হাওড়া ব্রিজের সরকারি নাম কী?
হাওড়া ব্রিজের সরকারি নাম হলো রবীন্দ্র সেতু। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে এই সেতুর নামকরণ করা হয়।
হাওড়া ব্রিজ নির্মাণে কত সময় লেগেছিল এবং কী বিশেষত্ব আছে?
হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ কাজ ১৯৩৬ সালে শুরু হয়ে ১৯৪২ সালে শেষ হয়, অর্থাৎ প্রায় ৬ বছর সময় লেগেছিল। এর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এটি একটিও নাট-বোল্ট ছাড়া সম্পূর্ণ রিভেট করে তৈরি করা হয়েছে।
হাওড়া ব্রিজ প্রতিদিন কত যানবাহন ও পথচারী বহন করে?
হাওড়া ব্রিজ প্রতিদিন প্রায় ১ লক্ষেরও বেশি যানবাহন এবং ১.৫ লক্ষেরও বেশি পথচারী বহন করে, যা এটিকে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ক্যান্টিলিভার সেতুতে পরিণত করেছে।
শেষ কথা
হাওড়া ব্রিজ শুধু একটি কংক্রিট আর ইস্পাতের কাঠামো নয়, এটি কলকাতার প্রাণশক্তি, এর গৌরবময় ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। ব্রিটিশ প্রকৌশলীদের মেধা আর ভারতীয় কর্মীদের কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ তৈরি হওয়া এই সেতু আজও সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটি শুধু দুটি শহরকে নয়, অগণিত স্মৃতি আর স্বপ্নকেও সংযুক্ত করে চলেছে অবিরাম।