শীতকাল অনেকের কাছেই প্রিয় ঋতু হলেও, এই সময়ে ত্বকের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ যত্নের। হিমেল হাওয়া ও শুষ্ক আবহাওয়া ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা কেড়ে নেয়, যার ফলে ত্বক হয়ে ওঠে রুক্ষ, শুষ্ক ও প্রাণহীন। সঠিক পরিচর্যার অভাবে দেখা দিতে পারে নানা ধরনের ত্বকের সমস্যা, যেমন – শুষ্কতা, চুলকানি, ঠোঁট ফাটা, গোড়ালি ফাটা এবং এমনকি একজিমার প্রকোপ বৃদ্ধি। তবে একটু সচেতনতা ও যত্নের মাধ্যমে খুব সহজেই শীতকালে ত্বক স্বাস্থ্যকর ও উজ্জ্বল রাখা সম্ভব। এই আর্টিকেলে আমরা শীতকালে ত্বকের যত্নের বিস্তারিত নিয়মাবলী, বিভিন্ন ত্বকের জন্য টিপস এবং ঘরোয়া প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব।
শীতকালে ত্বকের সাধারণ সমস্যা
শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় ত্বক তার স্বাভাবিক আর্দ্রতা হারায়। এর ফলে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে:
- শুষ্কতা ও টানটান ভাব: ত্বকের উপরিভাগের স্তর থেকে পানি দ্রুত উবে যায়, ফলে ত্বক শুষ্ক ও টানটান হয়ে যায়।
- চুলকানি ও জ্বালা: শুষ্কতার কারণে ত্বকে চুলকানি ও জ্বালা অনুভূত হতে পারে।
- ঠোঁট ও গোড়ালি ফাটা: ঠোঁট এবং পায়ের গোড়ালি শুষ্ক হয়ে ফেটে যাওয়া শীতের একটি সাধারণ সমস্যা।
- একজিমা ও র্যাশ: যাদের একজিমা বা অ্যালার্জিজনিত সমস্যা আছে, শীতকালে তাদের ত্বকের সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।
- নিস্তেজ ও মলিন ত্বক: আর্দ্রতার অভাবে ত্বক তার উজ্জ্বলতা হারিয়ে নিস্তেজ দেখায়।
- তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যা: তৈলাক্ত ত্বকেও শীতকালে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, যা অতিরিক্ত তেল উৎপাদন এবং ব্রণ বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
শীতকালীন ত্বকের যত্নের অপরিহার্য ধাপসমূহ
১. সঠিক ক্লিনজার ব্যবহার করুন
শীতকালে এমন ক্লিনজার ব্যবহার করুন যা মৃদু, ক্রিম-ভিত্তিক, সালফেট-মুক্ত এবং অ্যালকোহল-মুক্ত। অতিরিক্ত ফোমিং ক্লিনজার ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট করে ত্বককে আরও শুষ্ক করে তোলে। হালকা গরম জল (ঈষদুষ্ণ জল) দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন, খুব গরম জল ত্বকের আর্দ্রতা দ্রুত শুষে নেয়। মুখ ধোয়ার সময় আলতোভাবে ম্যাসাজ করুন এবং ঘন ঘন মুখ ধোয়া এড়িয়ে চলুন।
২. নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন
শীতে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার অপরিহার্য। শুষ্ক বা তৈলাক্ত, সব ধরনের ত্বকেই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা প্রয়োজন। স্নানের পর বা মুখ ধোয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেজা ত্বকে ময়েশ্চারাইজার লাগালে তা আর্দ্রতা ধরে রাখতে বেশি কার্যকর হয়। ক্রিমি এবং সমৃদ্ধ ময়েশ্চারাইজার বেছে নিন, যাতে হায়ালুরোনিক অ্যাসিড, সিরামাইডস, শিয়া বাটার বা গ্লিসারিনের মতো উপাদান থাকে।
৩. সানস্ক্রিন ব্যবহার ভুলবেন না
শীতকালে সূর্যের তেজ কম মনে হলেও, ক্ষতিকারক ইউভি রশ্মি ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। তাই প্রতিদিন সকালে কমপক্ষে SPF 30 বা তার বেশি যুক্ত একটি সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন, এমনকি মেঘলা দিনেও।
৪. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন
শীতকালে অনেকেই পানি কম পান করেন, যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। ত্বক ও শরীর সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত, এতে ত্বক ভেতর থেকে হাইড্রেটেড থাকে।
৫. এক্সফোলিয়েশন সীমিত করুন
শীতকালে ত্বকের প্রতিরক্ষা স্তর দুর্বল থাকে। তাই শারীরিক স্ক্রাব বা তীব্র অ্যাসিড-যুক্ত এক্সফোলিয়েটর ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন। যদি এক্সফোলিয়েট করতেই হয়, তবে সপ্তাহে একবার খুব হালকা রাসায়নিক এক্সফোলিয়েটর (যেমন AHA বা BHA) ব্যবহার করতে পারেন।
৬. ঠোঁট ও হাতের বিশেষ যত্ন নিন
শীতকালে ঠোঁট ও হাত দ্রুত শুষ্ক হয়ে ফেটে যায়। প্যারাবেন-মুক্ত, পেট্রোলিয়াম জেলি বা প্রাকৃতিক তেলের তৈরি SPF-যুক্ত লিপ বাম ব্যবহার করুন। নিয়মিত হ্যান্ড ক্রিম ব্যবহার করুন, বিশেষ করে কাপড় ধোয়ার পর বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের পর।
৭. গোসলের অভ্যাস পরিবর্তন করুন
ঠান্ডা দিনে গরম জলে স্নান করতে ভালো লাগলেও, এটি ত্বকের আর্দ্রতা দ্রুত শুষে নেয়। তাই হালকা গরম জলে (কুসুম গরম) অল্প সময় ধরে স্নান করুন। গোসলের পানিতে কয়েক ফোঁটা জোজোবা বা বাদাম তেল মিশিয়ে নিলে তা ত্বককে আর্দ্র ও মসৃণ রাখতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন ত্বকের জন্য বিশেষ যত্ন
শুষ্ক ত্বকের যত্ন
শুষ্ক ত্বকের জন্য হায়ালুরোনিক অ্যাসিড, অ্যাজেলেইক অ্যাসিড, অ্যালানটোইন এবং গ্লিসারিনের মতো উপাদান সমৃদ্ধ ক্রিম-ভিত্তিক ক্লিনজার ব্যবহার করুন। পুষ্টিকর ও ঘন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। রাতে ঘুমানোর আগে ফেস অয়েল ব্যবহার করতে পারেন।
তৈলাক্ত ত্বকের যত্ন
তৈলাক্ত ত্বক মানে এই নয় যে শীতেও ত্বক তৈলাক্ত থাকবে। এ সময় ত্বক শুষ্ক, রুক্ষ হয়ে যেতে পারে। তৈলাক্ত ত্বকে ব্ল্যাকহেডস, হোয়াইটহেডসের সমস্যা থাকে। হালকা জেল-ভিত্তিক ক্লিনজার ব্যবহার করুন এবং ময়েশ্চারাইজার হিসেবে হালকা জেল বা ওয়াটার-বেসড ময়েশ্চারাইজার বেছে নিন। টি ট্রি অয়েল ব্রণ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
সংবেদনশীল ত্বকের যত্ন
সংবেদনশীল ত্বক শীতকালে আরও বেশি শুষ্ক, রুক্ষ এবং প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ঠান্ডা বাতাস, কম আর্দ্রতা এবং ঘরের ভেতরের হিটিং সিস্টেমের তাপ ত্বককে ডিহাইড্রেটেড করে তোলে এবং লালচে ভাব, চুলকানি ভাব বাড়িয়ে দিতে পারে। মৃদু এবং অ্যালকোহল-মুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার করুন। হায়ালুরোনিক অ্যাসিড, সিরামাইডস এবং শিয়া বাটার সমৃদ্ধ ঘন ময়েশ্চারাইজার বেছে নিন। ত্বক এক্সফোলিয়েট করা এড়িয়ে চলুন বা কমান।
ঘরোয়া উপায়ে ত্বকের যত্ন
- মধু ও গ্লিসারিন: মধু একটি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার। মধু আর গ্লিসারিন একসাথে মিশিয়ে ত্বকে লাগালে তা আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে, বিশেষ করে ফাটা ঠোঁট ও গোড়ালির জন্য কার্যকর।
- নারকেল তেল ও অলিভ অয়েল: খাঁটি নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল শীতকালে ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে অত্যন্ত উপকারী। গোসলের পর হালকা গরম তেল ম্যাসাজ করলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং ত্বক মসৃণ থাকে।
- দুধের সর ও বেসন: দুধের সর, মধু ও বেসনের মিশ্রণ ত্বকের আর্দ্রতা বৃদ্ধি করে এবং উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- কলা দিয়ে ফেসপ্যাক: কলা দিয়ে তৈরি ফেসপ্যাক ত্বককে নরম, মসৃণ এবং ব্রণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন: ঘরের ভেতরের হিটিং সিস্টেম বাতাসকে শুষ্ক করে তোলে। রাতে শোওয়ার সময় বা দিনের বেলায় ঘরে একটি হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করলে বাতাসে আর্দ্রতা বজায় থাকে এবং ত্বক ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা পায়।
- সুতি কাপড় পরিধান: যাদের অ্যালার্জিজনিত সমস্যা আছে, তারা উলের কাপড়ের নিচে সুতি বা ফ্লানেল কাপড়ের জামা পরতে পারেন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি, কারণ ঘুমের সময় ত্বক নিজের কোষগুলোকে পুনর্গঠনের কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে।
- রাতে ত্বকের যত্ন: রাতে মেকআপ ও সানস্ক্রিন ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। এরপর মৃদু ক্লিনজার, হাইড্রেটিং টোনার, সিরাম, আই ক্রিম এবং শেষে ঘন ময়েশ্চারাইজার বা নাইট ক্রিম ব্যবহার করুন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
যদি নিয়মিত যত্ন নেওয়ার পরও ত্বকের শুষ্কতা, চুলকানি, লালচে ভাব বা ফাটল না কমে, অথবা যদি একজিমা বা স্ক্যাবিসের মতো সমস্যা দেখা দেয়, তবে দেরি না করে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক চিকিৎসা জটিলতা এড়াতে সাহায্য করবে।
উপসংহার
শীতকালে ত্বকের যত্ন কেবল সৌন্দর্য রক্ষার জন্যই নয়, ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্যও অত্যন্ত জরুরি। উপরোক্ত নিয়মাবলী মেনে চললে আপনার ত্বক থাকবে সতেজ, কোমল ও উজ্জ্বল। মনে রাখবেন, ধারাবাহিক যত্নই সুন্দর ত্বকের চাবিকাঠি।