কলকাতা, একাধারে আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী শহর। এই শহরের বুকে এমনই এক স্থাপত্য দাঁড়িয়ে আছে, যা যেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরব আর ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন। আমরা কথা বলছি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নিয়ে। সাদা মার্বেলের এই বিশাল স্মৃতিসৌধটি শুধু একটি ইমারত নয়, এটি ইতিহাসের সাক্ষী, শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন এবং কলকাতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা কলকাতা এসেছেন বা আসবেন ভাবছেন, তাদের জন্য এই অসাধারণ স্থানটি ঘুরে দেখা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
ইতিহাসের পাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল
রানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে
১৯০১ সালের ২২শে জানুয়ারি, ভারতের তৎকালীন সম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়ার প্রয়াণ হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক বিশাল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই শোককে স্মরণীয় করে রাখতে এবং রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন কলকাতায় একটি বিশাল স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তার স্বপ্ন ছিল, এই সৌধটি এমন হবে যা চিরকাল রানীর মহিমা ও ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেবে।
নির্মাণশৈলী ও কারুকার্য
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯০৬ সালে এবং শেষ হয় ১৯২১ সালে। প্রায় ১৫ বছর ধরে চলেছিল এর নির্মাণ প্রক্রিয়া। এই বিশাল স্থাপত্যটির নকশা করেন ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টের প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়াম এমারসন। মজার বিষয় হলো, প্রথমে তাকে ইতালীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীতে নকশা করতে বলা হলেও, তিনি শুধু ইউরোপীয় শৈলীর বিরোধিতা করে ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীর সঙ্গে মুঘল স্থাপত্যের উপাদান মিশিয়ে দেন। এই কারণে, অনেকেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে ‘কলকাতার তাজমহল’ বা ‘তাজ অফ দ্য রাজ’ নামেও ডেকে থাকেন। নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা, যা তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও দেশীয় রাজাদের অনুদানে সংগৃহীত হয়েছিল।

স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন
শ্বেতপাথরের মহিমা
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সম্পূর্ণভাবে রাজস্থানের মাকরানা শ্বেতপাথর দিয়ে নির্মিত। এই পাথরই আগ্রার তাজমহলের নির্মাণেও ব্যবহৃত হয়েছিল। দিনের আলোতে এই সাদা মার্বেল পাথরের চাকচিক্য এবং রাতের কৃত্রিম আলোয় এর মায়াবী রূপ পর্যটকদের মুগ্ধ করে। মেমোরিয়ালের প্রধান গম্বুজটি বিশাল এবং এর চারটি কোণে রয়েছে চারটি ছোট গম্বুজাকার টাওয়ার, যা স্থাপত্যে এক বিশেষ নান্দনিকতা যোগ করেছে।
বিজয়ের দেবী
সৌধের সর্বোচ্চ গম্বুজের চূড়ায় দেখতে পাবেন বিজয়ের দেবী ‘অ্যাঞ্জেল অফ ভিক্টোরি’-এর একটি কালো ব্রোঞ্জের মূর্তি। এই মূর্তিটি একটি বল-বিয়ারিং যুক্ত পাদপীঠের উপর স্থাপিত, যার ফলে বাতাসের গতিতে এটি ঘোরে। এই মূর্তিটি যেন মেমোরিয়ালের মুকুটে এক ঝলমলে পালক।

কী দেখবেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে?
জাদুঘর ও গ্যালারি
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল শুধুমাত্র একটি স্মৃতিসৌধ নয়, এটি একটি সমৃদ্ধ জাদুঘরও বটে। এর ভেতরে ২৫টি বিশাল গ্যালারি রয়েছে, যেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের প্রচুর ঐতিহাসিক নিদর্শন, শিল্পকর্ম, চিত্রাঙ্কন (ব্রিটিশ ও প্রাচ্য ঘরানার তৈলচিত্র), ভাস্কর্য, রানী ভিক্টোরিয়ার ব্যবহৃত জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র এবং দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়।
- রয়্যাল গ্যালারি: এখানে রানী ভিক্টোরিয়ার জীবন ও সময়ের বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শিত হয়।
- কলকাতা গ্যালারি: ১৯৯২ সালে উদ্বোধন হওয়া এই বিশেষ গ্যালারিতে কলকাতার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং এর বিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
- এছাড়াও রয়েছে স্কাল্পচার গ্যালারি, সেন্ট্রাল হল, পোট্রেট গ্যালারি, আর্মস অ্যান্ড আর্মার গ্যালারি, যেখানে তৎকালীন সময়ের নানা সামগ্রী ও শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে।
জাদুঘরের প্রতিটি কোণে যেন ইতিহাস কথা বলে। বিভিন্ন শিল্পকর্ম ও প্রাচীন জিনিসপত্র আপনাকে অতীতের এক গৌরবময় সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
সবুজ বাগান ও ভাস্কর্য
মেমোরিয়ালটি ৬৪ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এক বিশাল ও সুসজ্জিত বাগানের মধ্যে অবস্থিত। এই বাগানটি কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় স্থান, যেখানে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় অসংখ্য মানুষ আসেন হাঁটতে, জিম করতে বা প্রকৃতির স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে। বাগানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, ফুল এবং একাধিক জলাশয়। এছাড়া, বাগানের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সুন্দর ভাস্কর্য ও মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, যা বাগানের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এটি শীতকালে পিকনিকের জন্যও একটি দারুণ স্পট।

লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো: আলোর খেলায় ইতিহাস
প্রতি সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রাঙ্গণে এক অসাধারণ আলো ও ধ্বনির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এই ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’-এর মাধ্যমে কলকাতার ঐতিহ্য ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ইতিহাস অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হয়। শোটি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই উপভোগ করা যায়। এটি ‘প্রাইড অ্যান্ড গ্লোরি – দ্য স্টোরি অফ ক্যালকাটা’ নামে পরিচিত। এই শোটি সোমবার ও অন্যান্য জাতীয় ছুটি ছাড়া প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে দেখানো হয়। যদিও কিছু সময় সরঞ্জামগত কারণে এটি স্থগিত থাকতে পারে, তবে এটি মেমোরিয়াল পরিদর্শনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা যোগ করে।
ভ্রমণের খুঁটিনাটি
সময়সূচী ও প্রবেশমূল্য
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সারা বছরই পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে, তবে জাদুঘরের একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী রয়েছে।
- জাদুঘর (গ্যালারি): মঙ্গলবার থেকে রবিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সোমবার এবং জাতীয় ছুটির দিনগুলিতে জাদুঘর বন্ধ থাকে। টিকিট কাউন্টার বন্ধ হওয়ার ৩০ মিনিট আগে বন্ধ হয়ে যায়।
- বাগান: প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
প্রবেশমূল্য (টিকিট):
জাদুঘর ও বাগানের জন্য আলাদা টিকিট রয়েছে।
| দর্শনার্থীর বিভাগ | জাদুঘরের টিকিট মূল্য (প্রতি ব্যক্তি) | বাগানের টিকিট মূল্য (প্রতি ব্যক্তি) |
|---|---|---|
| ভারতীয় নাগরিক | ৫০ টাকা | ২০ টাকা |
| সার্ক/বিমস্টেক দেশের নাগরিক | ১০০ টাকা | ২০ টাকা |
| বিদেশী নাগরিক | ৫০০ টাকা | ২০ টাকা |
কীভাবে পৌঁছাবেন
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কলকাতার একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত, তাই এখানে পৌঁছানো খুবই সহজ।
- মেট্রো: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নিকটতম মেট্রো স্টেশন হল ময়দান (Maidan) এবং রবীন্দ্র সদন (Rabindra Sadan)। স্টেশন থেকে হেঁটে বা অটো/ট্যাক্সি নিয়ে সহজেই পৌঁছানো যায়।
- বাস: কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছাকাছি নিয়মিত বাস চলাচল করে।
- ট্যাক্সি/ক্যাব: শহরের যেকোনো জায়গা থেকে সহজেই ট্যাক্সি বা অ্যাপ-ক্যাব বুক করে সরাসরি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পৌঁছানো যায়।
- রেল: নিকটতম প্রধান রেলওয়ে স্টেশন হল হাওড়া এবং শিয়ালদহ। এখান থেকে ট্যাক্সি বা বাস নিয়ে প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পৌঁছানো যায়।
এছাড়া, মেমোরিয়ালের গেটের সামনে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পাবেন, যা আপনাকে আশেপাশের এলাকায় ঘুরে দেখার এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেবে।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পরিদর্শনের পাশাপাশি আপনি এর কাছাকাছি আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে পারেন:
- সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল
- এম. পি. বিড়লা তারামণ্ডল
- অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস
- নন্দন প্রেক্ষাগৃহ
- রবীন্দ্র সদন
- কলকাতা রেস কোর্স
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
প্রশ্ন ১: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কি প্রতিদিন খোলা থাকে?
না, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরের জাদুঘরটি সোমবার এবং জাতীয় ছুটির দিনগুলিতে বন্ধ থাকে। তবে, এর সুবিশাল বাগানটি প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
প্রশ্ন ২: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ছবি তোলা যায় কি?
সাধারণত, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। তবে, বাইরের বাগান এবং স্মৃতিসৌধের ছবি তোলার অনুমতি রয়েছে।
প্রশ্ন ৩: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঘুরতে কত সময় লাগে?
পুরো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এবং এর বাগান ভালোভাবে ঘুরে দেখতে আপনার কমপক্ষে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। যদি আপনি প্রতিটি গ্যালারি মনোযোগ দিয়ে দেখতে চান, তাহলে আরও বেশি সময় লাগতে পারে।
উপসংহার
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল শুধুমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মারক নয়, এটি ভারতীয় স্থাপত্য, শিল্প এবং ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। এর শ্বেতপাথরের মহিমা, সুবিশাল বাগান এবং সমৃদ্ধ জাদুঘর এটিকে কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে। যারা কলকাতা আসেন, তাদের জন্য এই রাজকীয় ঐতিহ্য পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা সত্যিই অবিস্মরণীয়। তাই, আপনার পরবর্তী কলকাতা ভ্রমণে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে অবশ্যই আপনার ভ্রমণ তালিকায় রাখুন!