পুরনো কলকাতার অলিগলি: ইতিহাসের পদচিহ্ন ধরে এক অনাড়ম্বর যাত্রা

কলকাতা, শুধু একটি শহর নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস। আধুনিকতার চাকচিক্যের আড়ালে আজও তার বুকে লুকিয়ে আছে অসংখ্য পুরনো অলিগলি, যেখানে কান পাতলে শোনা যায় শত শত বছরের পুরোনো গল্প। এই অলিগলিগুলো কলকাতার আত্মা, যেখানে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম, শিল্প-সাহিত্য থেকে দৈনন্দিন জীবন, সবকিছুরই পদচিহ্ন লেগে আছে। আসুন, আজ আমরা সেই ইতিহাসের পরতে পরতে ডুব দিই, হেঁটে চলি পুরনো কলকাতার অলিগলির মধ্য দিয়ে, যেখানে প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে নতুন এক বিস্ময়!

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অলিগলি: যেখানে ইতিহাস কথা বলে

কলকাতার প্রতিটি পুরনো গলি যেন এক একটি খোলা বই। এদের মধ্যে কয়েকটি তো এতটাই জনপ্রিয় যে, ইতিহাস আর বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

কুমোরটুলি: প্রতিমা গড়ার এক প্রাচীন শিল্পকেন্দ্র

উত্তর কলকাতার এক কোণে হুগলি নদীর পাশ ঘেঁষে অবস্থিত কুমোরটুলি। এটি শুধু একটি পাড়া নয়, এটি মৃৎশিল্পীদের এক ঐতিহ্যবাহী বসতি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এখানকার শিল্পীরা মাটির প্রতিমা গড়ে চলেছেন, যা শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পূজা মণ্ডপেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হয়। দুর্গাপূজা আসার মাসখানেক আগে থেকেই এখানকার প্রতিটি গলিতে মাটির গন্ধ আর ছেনির শব্দে এক অন্যরকম উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। এখানে আপনি দেখতে পাবেন কীভাবে মাটি, খড় আর রংয়ের ছোঁয়ায় দেবদেবীর প্রাণবন্ত রূপ তৈরি হয়।

শোভাবাজার রাজবাড়ি: ইতিহাসের সাক্ষী এক জমিদারবাড়ি

শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের তৈরি এই রাজবাড়ি কলকাতার অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক জমিদারবাড়ি। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর রাজা নবকৃষ্ণ দেব এই বাড়িতেই প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন, যেখানে রবার্ট ক্লাইভও অতিথি হয়েছিলেন। আজও এই রাজবাড়িতে ঐতিহ্য মেনে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, যা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ ভিড় জমান। এর বিশাল উঠান, ঠাকুরদালান এবং অতীতের স্থাপত্যশৈলী আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই স্বর্ণযুগে।

মার্বেল প্যালেস: শিল্প ও ঐতিহ্যের এক বিরল সংগম

মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে অবস্থিত মার্বেল প্যালেস উত্তর কলকাতার এক অমূল্য রত্ন। ১৮৩৫ সালে ধনী বাঙালি বণিক রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এটি নির্মাণ করেন। এর নাম মার্বেল প্যালেস কারণ এর দেয়াল, মেঝে ও ভাস্কর্য সবই ইতালীয় মার্বেলে তৈরি। এটি একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, যেখানে ইউরোপীয় চিত্রকর্ম, ভিক্টোরিয়ান আসবাবপত্র এবং অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। প্রাসাদের অভ্যন্তরে একটি ছোট চিড়িয়াখানাও আছে, যা ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রবেশের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন তথ্য ব্যুরো থেকে ২৪ ঘণ্টা আগে অনুমতি নিতে হয়।

কলেজ স্ট্রিট: বিদ্যার পীঠস্থান ও বইপাড়া

মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিটকে ‘বইপাড়া’ নামেও ডাকা হয়। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের বাজার এবং ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজার। এই ১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তায় রয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল এবং সংস্কৃত কলেজের মতো বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বইয়ের দোকান আর প্রকাশনা সংস্থা ছাড়াও এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ইন্ডিয়ান কফি হাউস, যা একসময় বুদ্ধিজীবী ও বিপ্লবীদের আড্ডাস্থল ছিল। এই গলিগুলোতে হাঁটলে অনুভব করা যায় জ্ঞান আর বিপ্লবের এক অন্যরকম স্পন্দন।

পুরনো কলকাতার অলিগলির বৈশিষ্ট্য

  • ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য: এই গলিগুলোতে আজও দেখা যায় ব্রিটিশ ও ঔপনিবেশিক আমলের বাড়িঘর, যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নানা গল্প।
  • সংস্কৃতি ও শিল্প: কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্প থেকে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া, প্রতিটি গলিই যেন বাংলার সংস্কৃতি ও শিল্পের ধারক ও বাহক।
  • মানুষের উষ্ণতা: পুরনো কলকাতার মানুষজনের মধ্যে আজও সেই পুরনো দিনের উষ্ণতা ও আতিথেয়তা অনুভব করা যায়।
  • খাদ্য সংস্কৃতি: গলিগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট খাবারের দোকানগুলোতে পাওয়া যায় আসল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী স্বাদের বিভিন্ন খাবার।

কিছু ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক

অলিগলির পাশাপাশি পুরনো কলকাতায় রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক, যা শহরের গল্পকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে:

  • ফোর্ট উইলিয়াম: ব্রিটিশদের নির্মিত প্রথম দিকের দুর্গ, যা কলকাতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
  • রাইটার্স বিল্ডিং: ব্রিটিশ শাসনামলে কেরানিদের অফিস ছিল, পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
  • বিডন স্ট্রিট: উত্তর কলকাতার একটি ব্যস্ত রাস্তা, যা পুরনো দিনের থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত।

পুরনো কলকাতার অলিগলিতে ভ্রমণের টিপস

এই ঐতিহাসিক অলিগলিগুলো ঘুরে দেখার জন্য কিছু টিপস আপনার যাত্রা আরও আনন্দময় করে তুলবে:

  • সকালে যাওয়া: সকালে গেলে ভিড় কম থাকে এবং অনেক জায়গার আসল চরিত্র উপভোগ করা যায়।
  • হাঁটার পরিকল্পনা: অনেক গলি সংকীর্ণ হওয়ায় হেঁটে ভ্রমণ করাই সবচেয়ে ভালো। আরামদায়ক জুতো পরুন।
  • গাইড সঙ্গে রাখা: যদি সম্ভব হয়, একজন স্থানীয় গাইড সঙ্গে নিন, যিনি প্রতিটি স্থানের পেছনের গল্প বলতে পারবেন।
  • ক্যামেরা প্রস্তুত রাখুন: প্রতিটি বাঁকেই ছবির মতো সুন্দর দৃশ্য পাওয়ার সুযোগ থাকবে।
  • স্থানীয় খাবারের স্বাদ: রাস্তার ধারের ছোট দোকানগুলোতে স্থানীয় জলখাবারের স্বাদ নিতে ভুলবেন না।

এক নজরে পুরনো কলকাতার কিছু ঐতিহাসিক অলিগলি

অলিগলির নাম মূল আকর্ষণ ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশেষ টিপস
কুমোরটুলি মাটির প্রতিমা শিল্প, দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শতাব্দী প্রাচীন মৃৎশিল্পীদের বসতি, আন্তর্জাতিক প্রতিমা রপ্তানি দুর্গাপূজার আগে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) গেলে কাজের প্রক্রিয়া দেখা যায়
শোভাবাজার রাজবাড়ি প্রাচীন দুর্গাপূজা, জমিদারী স্থাপত্য পলাশীর যুদ্ধের পর প্রথম দুর্গাপূজা, রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাসস্থান পূজার সময় (অক্টোবর-নভেম্বর) বিশেষ ভিড় থাকে
মার্বেল প্যালেস ইতালীয় মার্বেলের স্থাপত্য, শিল্পকর্ম ও ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা, বিরল শিল্প সংগ্রহ প্রবেশের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দফতর থেকে পূর্ব অনুমতি প্রয়োজন
কলেজ স্ট্রিট বইয়ের বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কফি হাউস প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, বুদ্ধিজীবী আড্ডার কেন্দ্র বিভিন্ন প্রকাশনা ও পুরনো বইয়ের দোকান ঘুরে দেখুন

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

পুরনো কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত অলিগলি কোনটি?

পুরনো কলকাতার বেশ কয়েকটি অলিগলিই খুব বিখ্যাত। এর মধ্যে কুমোরটুলি তার প্রতিমা শিল্পের জন্য, কলেজ স্ট্রিট তার বইপাড়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এবং শোভাবাজার রাজবাড়ির আশেপাশের গলিগুলো তার ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

মার্বেল প্যালেসে প্রবেশের জন্য কি কোনো অনুমতি লাগে?

হ্যাঁ, মার্বেল প্যালেস একটি ব্যক্তিগত বাসস্থান হওয়ায়, এখানে প্রবেশের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন তথ্য ব্যুরো থেকে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা আগে অনুমতি নিতে হয়। প্রবেশ বিনামূল্যে হলেও এই অনুমতি পত্র থাকা আবশ্যক।

কলেজ স্ট্রিট কেন বিখ্যাত?

কলেজ স্ট্রিট মূলত তার বিশাল বইয়ের বাজার এবং ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য বিখ্যাত। এটি ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজার এবং এখানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু স্কুল ও ইন্ডিয়ান কফি হাউসের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা একে জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র করে তুলেছে।

উপসংহার

কলকাতার অলিগলিগুলো শুধু রাস্তা নয়, তারা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই গলিগুলোতে হাঁটলে কেবল অতীতেরই নয়, বর্তমানের স্পন্দনও অনুভব করা যায়। তাই, যদি কলকাতার আসল স্বাদ পেতে চান, তবে আধুনিক শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একবার ঘুরে আসুন এই ঐতিহাসিক অলিগলিগুলো থেকে। বিশ্বাস করুন, এই যাত্রা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এক অন্য কলকাতা, এক অন্য সময়ের গভীরে!

Leave a Comment