নতুন দিগন্তে বাংলা সিনেমা: ২০২৪-২৫ সালের আলোচিত চলচ্চিত্র ও আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ

নতুন সিনেমা হলে মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত বাংলা সিনেমা

বাংলা সিনেমার জগৎ বর্তমানে এক নতুন অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতি, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য এবং দর্শকদের পরিবর্তিত রুচির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প নিজেদের নতুন করে উপস্থাপন করছে। বিশেষ করে ২০২৪ এবং ২০২৫ সাল জুড়েই আমরা ভারতীয় বাংলা এবং বাংলাদেশী উভয় সিনেমাতেই উল্লেখযোগ্য মুক্তি এবং বক্স অফিস সাফল্য দেখেছি। এর পাশাপাশি, আধুনিক প্রেক্ষাগৃহগুলি দর্শকদের জন্য এনেছে এক নতুন অভিজ্ঞতা, যা সিনেমার প্রতি তাদের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

২০২৪-২৫ সালের বাংলা সিনেমার পোস্টার কোলাজ
নতুন বাংলা সিনেমার পোস্টার ও শিল্পীদের কোলাজ।

ছবি: নতুন বাংলা সিনেমার পোস্টার ও শিল্পীদের কোলাজ।

বাংলা সিনেমার সাম্প্রতিক উত্থান

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা সিনেমার মান ও জনপ্রিয়তা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে রয়েছে উন্নত স্ক্রিনপ্লে, শক্তিশালী পরিচালনা এবং শিল্পীদের অনবদ্য অভিনয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরনের গল্পের উপস্থাপন দর্শকদের নতুন কিছু দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। সামাজিক বার্তা, থ্রিলার, রোম্যান্স এবং কমেডি – সব বিভাগেই তৈরি হচ্ছে মানসম্মত চলচ্চিত্র। এই উত্থানের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের একটি নতুন বিজ্ঞপ্তি। ২০২৫ সালের আগস্টে জারি করা এই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, রাজ্যের প্রতিটি সিনেমা হলে এবং মাল্টিপ্লেক্সের প্রতিটি স্ক্রিনে ৩৬৫ দিন ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাইম টাইম শো (বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে [1]। এটি বাংলা সিনেমার প্রচার ও দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধিতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

২০২৪-২৫ সালের আলোচিত বাংলা সিনেমা

গত দুই বছর বাংলা সিনেমার জন্য ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। অনেক নতুন এবং ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে যা দর্শক ও সমালোচক উভয় মহলেই প্রশংসা কুড়িয়েছে।

ভারতীয় বাংলা সিনেমার এক ঝলক

২০২৪ সালে ভারতীয় বাংলা সিনেমা বেশ কিছু সফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে। এর মধ্যে ‘বুমেরাং’ (২০২৪) ছবিটি বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য লাভ করে [21]। জিৎ ও রুক্মিণী মৈত্র অভিনীত এই অ্যাকশন কমেডি চলচ্চিত্রটি দর্শক ও সমালোচকদের কাছে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘টেক্কা’ এবং সন্দীপ রায় পরিচালিত ফেলুদা সিরিজ ‘নয়ন রহস্য’-ও ২০২৪ সালের উল্লেখযোগ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল [6]।

২০২৫ সালেও বেশ কিছু প্রতীক্ষিত ছবি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। উইন্ডোজ প্রোডাকশনস-এর ভৌতিক কমেডি চলচ্চিত্র ‘ভানুপ্ৰিয়া ভূতের হোটেল’ (যেটি ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫-এর আশেপাশে মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে) ইতিমধ্যেই দর্শকদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। মিমি চক্রবর্তী, সোহম মজুমদার এবং বনি সেনগুপ্তের মতো তারকারা এই ছবিতে অভিনয় করেছেন [12]। এছাড়া, ‘পাটালীগঞ্জের পুতুলখেলা’, ‘দেবী চৌধুরানী’ এবং ‘রক্তবীজ ২’-এর মতো ছবিগুলি ২০২৫ সালে মুক্তির পরিকল্পনায় রয়েছে যা ভারতীয় বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করছে [7, 17]।

বাংলাদেশী বাংলা সিনেমার উজ্জ্বল পারফরম্যান্স

বাংলাদেশী চলচ্চিত্রও ২০২৪-২৫ সালে দারুণ পারফরম্যান্স করেছে। শাকিব খান অভিনীত ‘তুফান’ (২০২৪) বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আয় করে বছরের সর্বোচ্চ আয়কারী বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে [1, 2]। এটি শুধু বক্স অফিস সাফল্যই নয়, দর্শকদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। শাকিব খানের আরেকটি আলোচিত ছবি ‘রাজকুমার’ (২০২৪) প্রায় ২৬ কোটি টাকা আয় নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল [1, 2]। এছাড়া, ‘দরদ’ (১০.২০ কোটি), ‘দেয়ালের দেশ’ (২.০ কোটি) এবং ‘ওমর’ (১.৫৭ কোটি)-এর মতো ছবিগুলিও বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করেছে এবং নতুন গল্পের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করেছে [1, 2]। ২০২৫ সালের জন্য ‘বোরবাদ’ এবং ‘তান্ডব’-এর মতো ছবিগুলিও উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তি পেতে চলেছে [2]।

আধুনিক প্রেক্ষাগৃহের ভূমিকা ও নতুন অভিজ্ঞতা

আধুনিক প্রেক্ষাগৃহগুলি বাংলা সিনেমার দর্শক অভিজ্ঞতায় একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। আরামদায়ক আসন, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম (যেমন ৭.১ ডলবি সারাউন্ড সাউন্ড), এবং ২কে/৪কে প্রজেকশন প্রযুক্তি দর্শকদের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতি দর্শকদের বিভিন্ন সিনেমা থেকে পছন্দের ছবিটি বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কলকাতার জনপ্রিয় কিছু সিনেমা হলের মধ্যে রয়েছে:

  • নন্দন (Nandan): কলকাতার একটি আইকনিক প্রেক্ষাগৃহ, যা বাংলা চলচ্চিত্রের প্রচার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু। ৪.৭ রেটিং প্রাপ্ত এই হলটি বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য পরিচিত [2]।
  • সিনেপোলিস লেক মল (Cinepolis Lake Mall): লেক মলের ভেতরে অবস্থিত এই মাল্টিপ্লেক্সটি ৪.৫ রেটিং নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি এবং আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা প্রদান করে [9]।
  • পিভিআর আভি মাল (PVR Avani Mall): হাওড়ায় অবস্থিত এই মাল্টিপ্লেক্সটি ৪.৪ রেটিং প্রাপ্ত এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন [14]।
  • মিরাজ সিনেমাস নিউটাউন (Miraj Cinemas Newtown): এটি নিউটাউনের একটি জনপ্রিয় মাল্টিপ্লেক্স যা ৪.৫ রেটিং নিয়ে পরিষ্কার হল এবং আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা প্রদান করে [13]।
  • প্রিয়া সিনেমা (Priya Cinema): রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে অবস্থিত একটি বাজেট-বান্ধব সিনেমা হল যা নতুন বাংলা চলচ্চিত্র এবং লাইভ পারফরম্যান্সের জন্য পরিচিত। এর রেটিং ৪.২ [6]।
কলকাতার একটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্সের ভেতর
একটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্সের ভেতর, আরামদায়ক আসন ও বড় স্ক্রিন দেখা যাচ্ছে।

ছবি: একটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্সের ভেতর, আরামদায়ক আসন ও বড় স্ক্রিন দেখা যাচ্ছে।

নির্বাচিত প্রেক্ষাগৃহের তুলনামূলক চিত্র

আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং দর্শকের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু নির্বাচিত প্রেক্ষাগৃহের একটি তুলনামূলক সারণী নিচে দেওয়া হলো:

প্রেক্ষাগৃহের নাম অবস্থান গুগল রেটিং প্রবেশগম্যতা (Wheelchair) পেমেন্ট অপশন
Cinepolis Lake Mall [9] লেক মার্কেট, কলকাতা ৪.৫ (২৪১৯৭ রিভিউ) পার্কিং, প্রবেশপথ, বসার জায়গা ডেবিট কার্ড, NFC
Nandan [2] এলগিন রোড, কলকাতা ৪.৭ (৩০৪১২ রিভিউ) পার্কিং, বসার জায়গা ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, NFC
Priya Cinema [6] রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, কলকাতা ৪.২ (১৪৪৫১ রিভিউ) পার্কিং, প্রবেশপথ ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, NFC
Miraj Cinemas Newtown [13] নিউটাউন, কলকাতা ৪.৫ (৫২৭৬ রিভিউ) পার্কিং, প্রবেশপথ, রেস্টরুম ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, NFC
Rupbani Cinema Hall [first code output, 9] সোমশপুর, ধনিয়াখালি ৪.১ (৯৩৯ রিভিউ) পার্কিং, প্রবেশপথ, রেস্টরুম ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, NFC

বক্স অফিস সাফল্য এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া

২০২৪-২৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বেশ কিছু বাংলা চলচ্চিত্র বক্স অফিসে আশাব্যঞ্জক ফল দেখিয়েছে। ‘তুফান’ এবং ‘রাজকুমার’-এর মতো বাংলাদেশী চলচ্চিত্রগুলি শুধু দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপীও ব্যাপক আয় করেছে, যা বাংলা চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে [1, 2]। ভারতীয় বাংলা সিনেমায় ‘বুমেরাং’-এর মতো ছবিগুলির সাফল্য প্রমাণ করে যে ভালো বিষয়বস্তু এবং সঠিক বিপণন থাকলে বাংলা ছবিগুলিও বাণিজ্যিক দিক থেকে সফল হতে পারে [21]। দর্শকদের প্রতিক্রিয়াও ইতিবাচক, তারা এখন আরও বেশি করে আঞ্চলিক ভাষার চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী হচ্ছেন, বিশেষ করে যখন মানসম্পন্ন প্রযোজনা এবং অভিনয়ের সমন্বয় ঘটে।

সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসা আনন্দিত দর্শক
দর্শকরা সিনেমা হলের বাইরে বেরিয়ে আসছেন, তাদের মুখে আনন্দের ছাপ।

ছবি: দর্শকরা সিনেমা হলের বাইরে বেরিয়ে আসছেন, তাদের মুখে আনন্দের ছাপ।

বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ

বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নতুন নীতি (প্রাইম টাইম স্লটে বাংলা ছবি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক) নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আরও ভালো ছবি বানাতে উৎসাহিত করবে এবং দর্শকদের জন্য বাংলা ছবি দেখা আরও সহজ করে তুলবে [1]। এছাড়াও, অনলাইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলির উত্থান বাংলা চলচ্চিত্রকে বৃহত্তর দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করছে। এটি নির্মাতাদের জন্য নতুন উপার্জনের পথ খুলে দিচ্ছে এবং দর্শকদের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ কন্টেন্ট উপভোগের সুযোগ তৈরি করছে [2, 4]। শিল্পীরাও মনে করেন, ভালো গল্পের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র তৈরি হলে বাংলা সিনেমার একটি শক্তিশালী ভবিষ্যৎ রয়েছে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

২০২৪-২৫ সালের সবচেয়ে সফল বাংলা সিনেমা কোনটি?

২০২৪ সালের বাংলাদেশী চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে শাকিব খান অভিনীত ‘তুফান’ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আয় করে সবচেয়ে সফল চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি ছিল [1, 2]। ভারতীয় বাংলা সিনেমায় জিৎ ও রুক্মিণী মৈত্র অভিনীত ‘বুমেরাং’ও বক্স অফিসে সাফল্য লাভ করে [21]।

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সিনেমার জন্য নতুন সরকারি নিয়ম কী?

২০২৫ সালের আগস্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যেখানে বলা হয়েছে যে, রাজ্যের প্রতিটি সিনেমা হল এবং মাল্টিপ্লেক্সের প্রতিটি স্ক্রিনে সারা বছর ধরে প্রতিদিন কমপক্ষে একটি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাইম টাইম শো (বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) বাধ্যতামূলকভাবে প্রদর্শন করতে হবে [1]।

আধুনিক সিনেমা হলগুলি দর্শকদের জন্য কী সুবিধা দেয়?

আধুনিক সিনেমা হলগুলি দর্শকদের জন্য উন্নত দেখার অভিজ্ঞতা প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক ডলবি সাউন্ড সিস্টেম, উচ্চ রেজোলিউশনের (২কে/৪কে) প্রজেকশন এবং প্রায়শই অনলাইন টিকিটিং ও স্ন্যাকস কাউন্টারের মতো সুবিধা [9, 13, first code output, 9].

Sources & References

Leave a Comment