আমাদের চোখ প্রকৃতির এক অমূল্য উপহার, যার মাধ্যমে আমরা চারপাশের জগতকে দেখি, অনুভব করি এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করি। আধুনিক জীবনযাত্রায় ডিজিটাল স্ক্রিনের অত্যাধিক ব্যবহার, দূষণ, এবং অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে চোখের ওপর চাপ বাড়ছে, যা দৃষ্টিশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সুস্থ ও উজ্জ্বল দৃষ্টি বজায় রাখতে দৈনন্দিন চোখের যত্ন অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে আমরা চোখের যত্নে কিছু সহজ কিন্তু কার্যকরী দৈনন্দিন করণীয় নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনাকে সারা জীবন সুস্থ চোখ রাখতে সাহায্য করবে।
প্রতিদিনকার যত্নের অভ্যাস
চোখের সুস্থতার জন্য কিছু সাধারণ অভ্যাস প্রতিদিন মেনে চলা উচিত:
-
চোখ পরিষ্কার রাখা
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এবং দিনের শেষে ঠান্ডা ও পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ভালোভাবে ধুয়ে নিন। এতে চোখে জমে থাকা ধুলোবালি ও ময়লা দূর হয় এবং চোখ সতেজ থাকে।
-
চোখ ঘষা এড়িয়ে চলুন
চোখে অস্বস্তি হলে বা চুলকালে চোখ ঘষা এড়িয়ে চলুন। কারণ হাতে লেগে থাকা ময়লা, ব্যাকটেরিয়া বা ধুলো চোখে সংক্রমণ বা জ্বালা সৃষ্টি করতে পারে। যদি চোখ ঘষার প্রয়োজন হয়, তবে পরিষ্কার হাত দিয়ে আলতো করে ঘষুন।
-
পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা পর্যাপ্ত ঘুম চোখের জন্য অপরিহার্য। ঘুমের অভাবে চোখ ক্লান্ত ও শুষ্ক হয়ে পড়ে, যা মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম চোখের পেশিগুলোকে বিশ্রাম দেয় এবং সতেজ রাখে।
-
হাত পরিষ্কার রাখা
চোখ স্পর্শ করার আগে বা কন্টাক্ট লেন্স পরার আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। এটি চোখে জীবাণু সংক্রমণ রোধে সহায়তা করে।
ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহারের সতর্কতা
কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের মতো ডিজিটাল স্ক্রিনের দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার চোখের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ কমাতে কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত:
-
২০-২০-২০ নিয়ম
ডিজিটাল স্ক্রিনে কাজ করার সময় প্রতি ২০ মিনিট পর পর অন্তত ২০ ফুট দূরের কোনো বস্তুর দিকে ২০ সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে থাকুন। এই নিয়মটি চোখের পেশিগুলোকে বিশ্রাম দেয় এবং চোখ শুষ্কতা থেকে রক্ষা করে। প্রয়োজনে ২০ মিনিট পর পর অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে পারেন।
-
স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা ও অবস্থান
কম্পিউটার মনিটর বা ফোনের স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা সহনীয় মাত্রায় রাখুন। অতিরিক্ত উজ্জ্বলতা চোখের ওপর চাপ বাড়ায়। মনিটর চোখ থেকে প্রায় এক হাত দূরে এবং চোখের স্তরের ২০ ডিগ্রি নিচে স্থাপন করা উচিত, যাতে চোখ চাপমুক্ত থাকে।
-
চোখের পলক ফেলা
স্ক্রিনে কাজ করার সময় আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে কম পলক ফেলি, যার ফলে চোখ শুষ্ক হয়ে যায়। নিয়মিত বিরতিতে চোখ পিটপিট করার অভ্যাস করুন। প্রতি মিনিটে ১৮ বার পলক ফেললে চোখ যথেষ্ট আর্দ্র থাকে।
-
অন্ধকারে ডিভাইস ব্যবহার নয়
সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরে টিভি, মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে স্ক্রিনের নীল আলো সরাসরি চোখের ওপর পড়ে রেটিনার ক্ষতি করতে পারে।
-
অ্যান্টি-গ্লেয়ার স্ক্রিন/চশমা
কম্পিউটারে দীর্ঘক্ষণ কাজ করলে অ্যান্টি-গ্লেয়ার স্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া, নীল রশ্মি প্রতিরোধক চশমা বা লেন্সও চোখের সুরক্ষায় সহায়ক।
চোখের জন্য উপকারী খাবার
চোখের সুস্থতার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ চোখের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে:
-
ভিটামিন এ, সি, ই, জিঙ্ক এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড
এই পুষ্টি উপাদানগুলো চোখের ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ছানি এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
-
উপকারী খাবার
আপনার খাদ্যতালিকায় গাজর, মিষ্টি আলু, পালং শাক, ব্রোকলি, কমলালেবু, ডিম, মাছ (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ), বাদাম, সূর্যমুখী বীজ এবং রঙিন ফলমূল ও শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করুন। গাজরে থাকা বিটা-ক্যারোটিন ভিটামিন এ তৈরি করে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শুষ্ক চোখ এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশন কমাতে সাহায্য করে।
চোখের ব্যায়াম
নিয়মিত চোখের ব্যায়াম চোখের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে এবং ক্লান্তি দূর করে:
-
চোখ ঘোরানো
মাথা স্থির রেখে চোখ ডান ও বাম দিকে, তারপর উপরে ও নিচে কয়েকবার ঘোরান। এটি চোখের পেশি শিথিল করে।
-
কাছে ও দূরে ফোকাস করা
একটি পেন্সিল নাক থেকে প্রায় ৬ ইঞ্চি দূরে ধরে তার ডগার দিকে তাকান। এরপর দ্রুত ১০-২০ ফুট দূরে থাকা কোনো বস্তুর দিকে তাকান। এটি ১০ বার পুনরাবৃত্তি করুন। এটি চোখের ফোকাস করার ক্ষমতা বাড়ায়।
-
পামিং
দুই হাতের তালু ঘষে গরম করে বন্ধ চোখের ওপর আলতো করে রাখুন। এতে চোখ আরাম পায় এবং ক্লান্তি দূর হয়।
-
আটের চিত্র (Figure of Eight)
১০ ফুট দূরে একটি কাল্পনিক ‘আট’ আঁকার চেষ্টা করুন এবং চোখ দিয়ে সেই রেখা অনুসরণ করুন। এটি চোখের নমনীয়তা বাড়ায়।
সাধারণ সতর্কতা ও জীবনযাপন
সুস্থ চোখের জন্য কিছু সাধারণ সতর্কতা ও জীবনযাপনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন:
-
সানগ্লাস ব্যবহার
বাইরে রোদে বের হলে UV প্রোটেকশনযুক্ত সানগ্লাস ব্যবহার করুন। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি ছানি ও অন্যান্য চোখের রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
-
ধূমপান ত্যাগ
ধূমপান চোখের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি ছানি, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এবং গ্লুকোমার ঝুঁকি বাড়ায়।
-
নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা
কোনো সমস্যা না থাকলেও নিয়মিত চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে চোখ পরীক্ষা করানো উচিত। বিশেষ করে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকলে নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি।
-
শরীরচর্চা
নিয়মিত শরীরচর্চা শরীরের রক্তনালীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখে এবং গ্লুকোমা ও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো রোগের ঝুঁকি কমায়।
-
পরিষ্কার চশমা/কন্টাক্ট লেন্স
যদি চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন, তবে সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন। অপরিষ্কার লেন্স বা চশমা চোখে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
-
প্রসাধনীর ব্যবহার
চোখে প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। ঘুমানোর আগে অবশ্যই চোখের মেকআপ পরিষ্কার করে ফেলুন। অন্যের ব্যবহৃত প্রসাধনী ব্যবহার করবেন না।
-
দূষণ ও ধুলোবালি থেকে সুরক্ষা
যানবাহনের ধোঁয়া, ধুলোবালি এবং দূষিত পরিবেশ চোখের জ্বালাপোড়া ও অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। বাইরে বের হলে চশমা ব্যবহার করুন।
-
পর্যাপ্ত পানি পান
শরীরকে যথেষ্ট পরিমাণে হাইড্রেটেড রাখা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। পর্যাপ্ত পানি পান করলে চোখ শুষ্ক হওয়ার সমস্যা কমে।
সুস্থ চোখ আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। দৈনন্দিন জীবনে উপরের সহজ অভ্যাসগুলো মেনে চললে আপনি আপনার চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে পারবেন এবং দীর্ঘকাল উজ্জ্বল দৃষ্টিশক্তি উপভোগ করতে পারবেন। মনে রাখবেন, চোখের যেকোনো গুরুতর সমস্যায় দ্রুত চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।