কুমোরটুলি: প্রতিমা শিল্পের এক জীবন্ত কিংবদন্তি

কলকাতার বুকে এমন একটি জায়গা আছে, যেখানে শুধু মাটি আর খড়ই থাকে না, থাকে শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া আর ভক্তিমাখা ভালোবাসা। এই জায়গাটি হলো কুমোরটুলি, যা প্রতিমা শিল্পের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। দুর্গাপূজা এলেই যেখানে মা দুর্গা সহ অন্যান্য দেব-দেবী মাটি থেকে জীবন পান, সেই কুমোরটুলি শুধু একটি পাড়া নয়, এটি বাঙালির ঐতিহ্য আর শিল্পের এক জীবন্ত ইতিহাস।

ভূমিকা: যেখানে মাটির স্পর্শে প্রাণ পায় দেবতারা

উত্তর কলকাতার আহিরীটোলা ও শোভাবাজারের মাঝে হুগলী নদীর পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কুমোরটুলি। এই সরু গলিগুলো বর্ষার আগে থেকেই মাটির সোঁদা গন্ধ আর শিল্পের ব্যস্ততায় ভরে ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, এমনকি বিদেশ থেকেও প্রবাসীরা তাদের পূজার জন্য কুমোরটুলির প্রতিমার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। এখানকার শিল্পীদের হাত ধরে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ প্রতিমা জীবন্ত হয়ে ওঠে, যা কেবল দেব-দেবী নয়, বাঙালির সংস্কৃতিরও প্রতিচ্ছবি।

কুমারটুলির ইতিহাস: মাটি থেকে ঐতিহ্য

কুমোরটুলির ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় প্রায় ১৭শ শতকের গোড়ার দিকে। কথিত আছে, সেই সময়ে নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে বহু কুমোর (মৃৎশিল্পী) ভালো উপার্জনের আশায় কলকাতায় এসে বসতি স্থাপন করেন। প্রথমে তারা মাটির হাঁড়ি, কলসি, থালা-বাসন তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

  • পলাশীর যুদ্ধের পর, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার বিভিন্ন পেশার মানুষদের জন্য আলাদা আলাদা এলাকা নির্দিষ্ট করে দেয়। এভাবেই শুঁড়িপাড়া, ছুতারপাড়া, কলুটোলা এবং কুমোরটুলি নামের পাড়াগুলির জন্ম হয়।
  • সেই সময় থেকেই কুমোররা ধনী জমিদারদের বাড়ির পূজার জন্য প্রতিমা তৈরি করা শুরু করেন। এই সময়েই শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজার জন্য প্রতিমা তৈরি করা শুরু হয়, যেখানে সিংহের পরিবর্তে ঘোড়ার ব্যবহার হয়েছিল, কারণ শিল্পীরা তখন সিংহ দেখেননি। অবাক করা বিষয়, সেই ঐতিহ্য আজও কিছু ক্ষেত্রে চলে আসছে!
  • ধীরে ধীরে বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজার প্রচলন বাড়লে কুমোরটুলির কদর আরও বাড়ে, কারণ সব মণ্ডপেই প্রতিমার চাহিদা বাড়ে।

প্রতিমা তৈরির অলৌকিক যাত্রা

একটি প্রতিমা তৈরি কেবল একটি কাজ নয়, এটি একটি সাধনা। বছরের পর বছর ধরে এই সাধনা করে আসছেন কুমোরটুলির শিল্পীরা। রথযাত্রার দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় এর প্রস্তুতি।

কাঠামো থেকে প্রতিমার জন্ম

রথযাত্রার দিন গণেশ ও লক্ষ্মীর পূজা করার পর শুরু হয় ‘কাঠামোপূজা’। প্রথমে বাঁশের কাঠামো তৈরি হয়। এরপর সেই বাঁশের ফ্রেমের উপর খড় ও সুতলি দিয়ে দেব-দেবীর অবয়ব তৈরি করা হয়। এই প্রাথমিক কাঠামোটাই প্রতিমার মূল ভিত্তি।

মাটি ও রঙের ম্যাজিক

কাঠামো তৈরি হওয়ার পর শুরু হয় আসল মাটির কাজ। প্রধানত দুই ধরণের মাটি ব্যবহার করা হয়:

  • এঁটেল মাটি: এই মাটি দিয়ে প্রথমে প্রতিমার শরীর গড়া হয়। এর আঠালো গুণ প্রতিমাকে একটি নির্দিষ্ট আকার দিতে সাহায্য করে।
  • বেলে মাটি: এঁটেল মাটির কাজ শেষ হলে, প্রতিমা মসৃণ করার জন্য বেলে মাটি ব্যবহার করা হয়। এটি প্রতিমাকে একটি সূক্ষ্ম ফিনিশিং দেয়।

বেশিরভাগ মাটি আসে গঙ্গা নদী থেকে, যদিও অনেক শিল্পী উলুবেড়িয়ার মাটিও পছন্দ করেন। একসময় কেবল একচালা প্রতিমার চল ছিল। তবে ১৯৩৭-৩৮ সালে কুমোরটুলির একটি বারোয়ারি পূজায় আগুন লাগার পর শিল্পী গোপেশ্বর পাল দোচালা প্রতিমার প্রচলন করেন।

কুমোরটুলিতে মাটির প্রতিমা তৈরির প্রাথমিক পর্যায়
খড় ও মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রতিমার প্রাথমিক কাঠামো।

প্রতিমা তৈরি ও মাটির কাজ শেষ হলে শুরু হয় রঙের প্রলেপ দেওয়ার পালা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক রঙ ও তুলির ছোঁয়ায় দেব-দেবী জীবন্ত হয়ে ওঠেন। আর মহালয়ার ভোরেই ঘটে সেই অলৌকিক মুহূর্ত – চক্ষুদান। দেবীর তৃতীয় নয়ন আঁকা হয়, যা প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। এই দিন থেকেই দেবীপক্ষের সূচনা হয়।

শিল্পীর হাতে জীবন পায় মা

কুমোরটুলির শিল্পীরা শুধু কারিগর নন, তাঁরা এক একজন যাদুকর। পুরুষদের পাশাপাশি বর্তমানে বহু মহিলা শিল্পীও এই পেশায় নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। নব্বইয়ের দশকে মালা পাল ও চায়না পালের মতো মহিলারা এই শিল্পে প্রবেশ করেন এবং বর্তমানে প্রায় ৩০ জন মহিলা শিল্পী কুমোরটুলিতে কাজ করছেন। মালা পাল তো ন্যাশনাল হ্যান্ডিক্রাফটস অ্যান্ড হ্যান্ডলুম মিউজিয়াম, নিউ দিল্লিতেও তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছেন। মোহনবাঁশী রুদ্রপাল, গোরাচাঁদ পাল, রাখাল পাল-এর মতো বহু প্রবীণ ও নবীন শিল্পী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

কুমোরটুলির শিল্পীর হাতে দেবীর চক্ষুদান
মহালয়ার সকালে দেবীর চোখ আঁকছেন একজন শিল্পী।

শুধু দুর্গাপূজা নয়, সারা বিশ্বের জন্য

কুমোরটুলি শুধু কলকাতার পূজার জন্যই প্রতিমা তৈরি করে না। এখানকার তৈরি দেব-দেবীর প্রতিমা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, ইতালি, মালয়েশিয়া, সুইডেন এবং আফ্রিকার প্রবাসী বাঙালিদের কাছেও কুমোরটুলির প্রতিমা সমাদৃত। ১৯৮৪ সালে গোরাচাঁদ পাল প্রথম লন্ডনে মাটির দুর্গা প্রতিমা রপ্তানি করেন, যা ছিল এক নতুন দিগন্তের সূচনা।

দুর্গাপূজা ছাড়াও এই শিল্পীরা কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, জগদ্ধাত্রী সহ আরও অনেক দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরি করেন। সারা বছর ধরেই তাদের কর্মশালাগুলিতে ব্যস্ততা লেগেই থাকে।

কুমোরটুলিতে এক ঝলক: কখন যাবেন, কী দেখবেন?

কুমোরটুলি পরিদর্শনের সেরা সময় হলো দুর্গাপূজার কয়েক মাস আগে থেকে, বিশেষ করে রথযাত্রা থেকে মহালয়া পর্যন্ত। এই সময়ে আপনি প্রতিমা তৈরির বিভিন্ন পর্যায় দেখতে পাবেন। কীভাবে খড় থেকে মাটি, আর মাটি থেকে রঙে প্রতিমা প্রাণ পাচ্ছে, তা নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারণ।

পাশাপাশি কুমোরটুলির আশেপাশে রয়েছে আরও কিছু দেখার মতো জায়গা:

  • কুমোরটুলি ঘাট: হুগলী নদীর পাড়ে অবস্থিত এই ঘাটটি শান্ত পরিবেশ এবং সুন্দর সূর্যাস্তের জন্য পরিচিত।
  • কুমোরটুলি পার্ক: এটি একটি জনপ্রিয় স্থান, বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় থিমভিত্তিক মণ্ডপ ও প্রতিমার জন্য।
  • বাগবাজার সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির: কুমোরটুলির কাছেই অবস্থিত একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মন্দির।
পরিবহনের জন্য প্রস্তুত কুমোরটুলির দুর্গা প্রতিমা
পূজা মণ্ডপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে সেজে ওঠা প্রতিমারা।

প্রতিমা তৈরির পর্যায়ক্রম

পর্যায় সময়কাল (আনুমানিক) প্রধান কাজ
কাঠামোপূজা রথযাত্রা (জুন-জুলাই) বাঁশ ও কাঠের কাঠামো তৈরি, পূজা
মাটির কাজ জুলাই-সেপ্টেম্বর খড় ও এঁটেল মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়া
শুকানো ও মসৃণকরণ আগস্ট-সেপ্টেম্বর প্রতিমা শুকানো, বেলে মাটি দিয়ে মসৃণ ফিনিশিং
রঙের প্রলেপ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর প্রাথমিক রঙ করা
চক্ষুদান মহালয়া (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) দেবীর চোখে রং করা, প্রাণ প্রতিষ্ঠা
সজ্জা ও শেষ মুহূর্তের কাজ পূজার ঠিক আগে বস্ত্র, অলংকার ও অন্যান্য সজ্জা

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

কুমোরটুলি নামের উৎপত্তি কীভাবে হলো?

কুমোরটুলি নামটি এসেছে ‘কুমোর’ বা ‘কুম্ভকার’ শব্দ থেকে, যার অর্থ মাটির কাজ করা শিল্পী। ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতায় পেশাভিত্তিক এলাকা ভাগ করার সময় মাটির কাজ করা শিল্পীদের এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করানো হয়েছিল, সেখান থেকেই এই নামের উৎপত্তি।

কুমোরটুলির প্রতিমা কেন এত বিখ্যাত?

কুমোরটুলির প্রতিমা তার শৈল্পিক দক্ষতা, ঐতিহ্যবাহী গঠন এবং সূক্ষ্ম কারুকার্যের জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। এখানকার শিল্পীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং তাদের হাতে তৈরি প্রতিমার প্রতিটি অংশে ভক্তি ও ভালোবাসার ছোঁয়া থাকে। একচালা ও দোচালা প্রতিমার বিশেষ বৈশিষ্ট্যও এটিকে অনন্য করেছে।

কুমোরটুলি পরিদর্শনের সেরা সময় কখন?

কুমোরটুলি পরিদর্শনের সেরা সময় হলো দুর্গাপূজার প্রায় ২-৩ মাস আগে থেকে, অর্থাৎ রথযাত্রা থেকে মহালয়া পর্যন্ত। এই সময়ে শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং আপনি পুরো প্রক্রিয়াটি কাছ থেকে দেখতে পারবেন। বিশেষ করে মহালয়ার দিনে চক্ষুদানের দৃশ্য দেখার মতো।

উপসংহার

কুমোরটুলি শুধু প্রতিমা তৈরির একটি স্থান নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং শিল্পের এক অদম্য প্রতীক। মাটির প্রতিমায় প্রাণ সঞ্চারের এই ধারা যেন যুগ যুগ ধরে বয়ে চলে, আর কুমোরটুলি হয়ে ওঠে প্রতিমা শিল্পের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। এখানকার প্রতিটি প্রতিমার পেছনে লুকিয়ে আছে শিল্পীর কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং গভীর ভক্তি, যা এটিকে কেবল একটি শিল্পকর্ম না রেখে, এক জীবন্ত সত্তায় রূপান্তরিত করে।

Leave a Comment