কলেজ স্ট্রিট: কলকাতা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক সাহিত্য তীর্থ

কলেজ স্ট্রিট: বইপ্রেমীদের স্বপ্নরাজ্য

কলকাতার বুকে এক অদ্ভুত জাদু লুকিয়ে আছে, যার নাম কলেজ স্ট্রিট। শুধু একটি রাস্তা নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, জ্ঞানের এক অবাধ প্রাঙ্গণ, আর বইপ্রেমীদের জন্য এক মায়াবী জগত। এই রাস্তা ধরে হাঁটলে আপনি অনুভব করবেন, যেন সময় থমকে গেছে, আর প্রতিটি ধুলোমাখা বইয়ের পাতায় লুকিয়ে আছে শত শত গল্প আর অজানা জগতের হাতছানি। এটি শুধু ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজারই নয়, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরোনো বইয়ের বাজার হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন ২০০৭ সালে ‘বেস্ট অফ এশিয়া’ তালিকায় কলেজ স্ট্রিটকে ভারতের এক উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ইতিহাসের পাতায় কলেজ স্ট্রিট: যেখানে জ্ঞানের দীপ জ্বলে

কলেজ স্ট্রিটের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। মজার ব্যাপার হলো, এই রাস্তাটি কিন্তু প্রথম দিকে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়নি। ১৮২১-২৩ সালের দিকে ‘লটারি কমিটি’ নামের একটি সংস্থা শহরের রাস্তাঘাট নির্মাণের দায়িত্বে ছিল, এবং সেই সময় ‘সেন্ট্রাল রোড’-এর অংশ হিসেবে কলেজ স্ট্রিট তৈরি হয়েছিল। এর আসল পরিচিতি গড়ে ওঠে ১৮১৭ সালে, যখন এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ (যা এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত)। এরপর একের পর এক গড়ে ওঠে হেয়ার স্কুল (১৮১৮), সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪), কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (১৮৩৫) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭)। এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই রাস্তাটির নাম হয়ে যায় ‘কলেজ স্ট্রিট’।

এই অঞ্চলের আনাচে-কানাচে জড়িয়ে আছে বহু মনীষীর স্মৃতি। রাজা রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, এমনকি বিপ্লবী বাঘা যতীনের মতো ব্যক্তিত্বদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এই পথ। কলেজ স্ট্রিটের প্রতিটি ধুলোবালি যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।

বইপাড়ার অলিগলি: যেখানে সব বইয়ের ঠিকানা

কলেজ স্ট্রিটকে ‘বইপাড়া’ বলা হয় তার কারণ এখানে আপনি কল্পনার অতীত যে কোনো বই খুঁজে পেতে পারেন। ফুটপাতের ধারে সারি সারি বইয়ের দোকান, যেখানে পুরোনো বইয়ের মন মাতানো গন্ধ আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে। এখানে আপনি পাবেন স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বই, গল্পের বই, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, এমনকি বিরল ও দুষ্প্রাপ্য সংস্করণও। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সহ বিভিন্ন ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাষার বইয়ের এক বিশাল সম্ভার এখানে মজুত। কথিত আছে, যে বই কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যায় না, সেই বইয়ের অস্তিত্বই নেই!

কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে পুরোনো বইয়ের স্তূপ
কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে সারি সারি পুরোনো বইয়ের দোকান।

নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরোনো বইয়ের বাজার এখানে এতটাই বিশাল যে, সঠিক দামে ভালো বই খুঁজে নেওয়াও এক ধরনের শিল্প। এখানে আনন্দ পাবলিশার্স, দে’জ পাবলিশিং, পত্র ভারতী, দেব সাহিত্য কুটীর-এর মতো স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থাগুলির প্রধান কার্যালয় রয়েছে। ‘দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ হলো কলেজ স্ট্রিটের অন্যতম প্রাচীন বইয়ের দোকান, যা ১৮৮৬ সাল থেকে বইপ্রেমীদের সেবা দিয়ে আসছে। এছাড়া, টেকনো ওয়ার্ল্ড, বুকস জাংশন, ইন্টারন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-এর মতো আধুনিক বইয়ের দোকানও রয়েছে, যা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বই থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ রাখে।

শিক্ষার পীঠস্থান: জ্ঞানের আলোকবর্তিকা

কলেজ স্ট্রিট কেবল বইয়ের জন্য বিখ্যাত নয়, এটি কলকাতার অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র। এই রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভবন
কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ভবন।

এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি তুলনামূলক তালিকা দেওয়া হলো:

প্রতিষ্ঠানের নাম প্রতিষ্ঠার বছর পরিচিতি বিশেষত্ব
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ১৮১৭ উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র, বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৫৭ উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বিস্তৃত পাঠক্রম, বহু ডিসিপ্লিনে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা
সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ১৮২৪ প্রাচীন ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির পঠন-পাঠন সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য, দর্শন ও ধর্মীয় গবেষণার কেন্দ্র
হিন্দু স্কুল ১৮১৭ ঐতিহ্যবাহী বালক বিদ্যালয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষা, বহু কৃতী ছাত্র তৈরি করেছে
হেয়ার স্কুল ১৮১৮ ঐতিহ্যবাহী বালক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড হেয়ারের নামে, শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

আড্ডা আর কফির কাপে: বুদ্ধিজীবীদের মিলনক্ষেত্র

কলেজ স্ট্রিট মানেই শুধু বই আর পড়াশোনা নয়, এর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এখানকার ‘আড্ডা’ সংস্কৃতি। আর আড্ডার কথা বললেই যার নাম সবার প্রথমে আসে, তা হলো – ইন্ডিয়ান কফি হাউস। ১৮৭৫-৭৬ সালে অ্যালবার্ট হল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই কফি হাউসটি শুধু একটি ক্যাফে নয়, এটি বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের মিলনক্ষেত্র। এখানে কফির কাপে ঝড় উঠেছে বহু বিপ্লবী পরিকল্পনা, সাহিত্যালোচনা আর সাংস্কৃতিক বিতর্কে। সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, মৃণাল সেন, অপর্ণা সেন-এর মতো বহু কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব ছিলেন এর নিয়মিত পৃষ্ঠপোষক।

ইন্ডিয়ান কফি হাউসের অভ্যন্তরে আড্ডা
ইন্ডিয়ান কফি হাউসে এক প্রাণবন্ত আড্ডার মুহূর্ত।

কফি হাউস ছাড়াও, দিলখুশা কেবিন, বসন্ত কেবিন, পুটিরামের মিষ্টির দোকান-এর মতো জায়গাগুলোও কলেজ স্ট্রিটের আড্ডার অন্যতম কেন্দ্র। বসন্ত কেবিন তার চিকেন কবিরাজি আর ফাউল কাটলেটের জন্য বিখ্যাত, যা পড়ুয়াদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এই জায়গাগুলো শুধুমাত্র খাবারের দোকান নয়, এগুলি কলকাতার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কলেজ স্ট্রিট: শুধু বই নয়, এক অভিজ্ঞতা

কলেজ স্ট্রিট শুধু ইঁট-কাঠ-পাথরের একটি রাস্তা নয়, এটি এক জীবন্ত অনুভূতির নাম। এখানে এলে আপনি অনুভব করবেন ইতিহাস আর বর্তমানের এক অদ্ভুত সহাবস্থান। পুরোনো বইয়ের গন্ধ, নতুন বইয়ের উজ্জ্বল মলাট, ছাত্রদের কোলাহল, কফি হাউসের পরিচিত গুঞ্জন, আর ফুটপাতের চাঞ্চল্য – সব মিলিয়ে কলেজ স্ট্রিট এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এটি এক সাহিত্য তীর্থ, যেখানে জ্ঞানের অন্বেষণ আর আড্ডা অবিরাম চলে। কলকাতায় এসে যদি আপনি কলেজ স্ট্রিটে না আসেন, তবে আপনার কলকাতা ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

কলেজ স্ট্রিট কিসের জন্য বিখ্যাত?

কলেজ স্ট্রিট মূলত তার বিশাল বইয়ের বাজারের জন্য বিখ্যাত, যা ভারতের বৃহত্তম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরোনো বইয়ের বাজার। এছাড়া, এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান কফি হাউস সহ বহু ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জন্য পরিচিত।

কলেজ স্ট্রিট পরিদর্শনের সেরা সময় কখন?

সপ্তাহের যে কোনো দিনই কলেজ স্ট্রিট খোলা থাকে, তবে রবিবার কিছু দোকান বন্ধ থাকতে পারে। সাধারণত সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা-৮টা পর্যন্ত দোকানগুলি খোলা থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি চালু থাকার সময় গেলে আপনি এখানকার আসল প্রাণবন্ত পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন। শীতকাল ভ্রমণের জন্য আরামদায়ক।

কলেজ স্ট্রিটে কি শুধু পুরোনো বই পাওয়া যায়?

না, কলেজ স্ট্রিটে শুধু পুরোনো বই নয়, নতুন বইও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এখানে বহু স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয় এবং আধুনিক বইয়ের দোকান রয়েছে যেখানে সব ধরণের নতুন বই পাওয়া যায়। পুরোনো বইয়ের স্টলগুলি ফুটপাতে বেশি দেখা যায়, তবে নির্দিষ্ট দোকানে নতুন বইয়ের বিশাল সম্ভার রয়েছে।

Leave a Comment