কলকাতার দুর্গা পূজা: এক অবিস্মরণীয় উৎসব

কলকাতার দুর্গাপূজা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির আবেগ, ঐতিহ্য আর শিল্পের এক অসাধারণ মেলবন্ধন। এই সময়টায় শহরের প্রতিটি কোণ এক নতুন সাজে সেজে ওঠে, ঝলমলে আলোয় ঝলসে ওঠে রাতের কলকাতা। হাজার হাজার প্যান্ডেলের বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্ম আর দেবীর মূর্তিতে ফুটে ওঠে কারিগরদের অসামান্য সৃজনশীলতা। দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি মিলন, আনন্দ, ফ্যাশন আর নতুনত্বের এক বৃহত্তর উদযাপন।

২০২১ সালে ইউনেস্কো কলকাতার দুর্গাপূজাকে ‘মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ (Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা এই উৎসবের বিশ্বব্যাপী গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই স্বীকৃতি কলকাতার দুর্গাপূজাকে কেবল ভারতের নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।

কলকাতার দুর্গাপূজার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

কলকাতায় দুর্গাপূজার ইতিহাস প্রায় চারশো বছরের পুরনো। এর সূচনা হয়েছিল জমিদার বাড়িগুলিতে, যেখানে দেবীর আরাধনা ছিল মূলত একটি পারিবারিক এবং অভিজাত আয়োজন। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারকে কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপূজার অন্যতম আয়োজক হিসেবে ধরা হয়। ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের উদ্যোগে আয়োজিত পূজা আরও পরিচিতি লাভ করে, যেখানে ইংরেজ অতিথিরাও আমন্ত্রিত হতেন।

উনিশ শতকের শেষের দিকে, এই ব্যক্তিগত পূজা ধীরে ধীরে ‘বারোয়ারি’ বা ‘সর্বজনীন’ রূপে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। ১৯১০ সালে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করে, যা সাধারণ মানুষকে এই মহা উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। এই নতুন ধারার মধ্য দিয়েই দুর্গাপূজা ব্যক্তিগত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে এসে পাড়ার মোড়ে, ক্লাবের মাঠে জনসমক্ষে পালিত হতে শুরু করে। মা দুর্গা এখানে কেবল দেবী নন, তিনি বাঙালির সংস্কৃতি, শক্তি এবং ঐক্যের প্রতীক। প্রতি বছর মহালয়ার দিন থেকে উৎসবের সূচনা হয়, যখন আকাশবাণীতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠের সুর ভেসে আসে এবং মনে করিয়ে দেয় মায়ের আগমনী বার্তা। এই সময় থেকে শুরু হয় উৎসবের প্রস্তুতি, যা বিজয়া দশমী পর্যন্ত চলে।

প্যান্ডেল হপিং: কলকাতার সেরা কিছু পূজা মণ্ডপ

দুর্গাপূজা মানেই কলকাতা জুড়ে প্যান্ডেল হপিং-এর এক অন্যরকম উন্মাদনা। শহরের প্রতিটি প্রান্তে তৈরি হয় থিমভিত্তিক প্যান্ডেল, যেখানে শিল্পীরা তাদের কল্পনার জগতকে মূর্ত করে তোলেন। প্যান্ডেলগুলি এক একটি চলমান শিল্প প্রদর্শনীতে পরিণত হয়, যা দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করে।

শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব

লেকটাউনের শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব প্রতি বছর তাদের জমকালো থিমের জন্য পরিচিত। তারা প্রায়শই বিখ্যাত মন্দির বা আন্তর্জাতিক স্থাপনার আদলে প্যান্ডেল তৈরি করে, যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। দেবীর প্রতিমা এখানে বহু কিলোগ্রাম সোনা দিয়ে সাজানো হয়, যা এক অত্যাশ্চর্য দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এখানকার আলোকসজ্জাও হয় চোখে পড়ার মতো, যা বহুদূর থেকে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।

শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের স্বর্ণালংকার পরিহিতা দেবী দুর্গা
শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবে দেবী দুর্গার অসাধারণ প্রতিমা।

কলেজ স্কোয়ার

মধ্য কলকাতার কলেজ স্কোয়ারের পূজা তার ঐতিহ্যবাহী সজ্জা এবং হ্রদের জলের উপর আলোকিত প্যান্ডেলের প্রতিচ্ছবির জন্য বিখ্যাত। এখানকার প্রতিমা এবং সাজসজ্জায় থাকে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। লেকের চারপাশের আলোর খেলা এবং মনোমুগ্ধকর প্রতিমা দেখতে প্রতি বছর উপচে পড়ে ভিড়।

সুরুচি সংঘ

নিউ আলিপুরের সুরুচি সংঘ তাদের সৃজনশীলতা এবং থিমের ভিন্নতার জন্য পরিচিত। তারা প্রায়শই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যকে তাদের প্যান্ডেল ও প্রতিমায় তুলে ধরে। সুরুচি সংঘের প্যান্ডেলগুলি রঙের উৎসব এবং আলোর ঝলকানিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যা একটি ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

কুমোরটুলি পার্ক

উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি পার্কের পূজা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সেই এলাকার ঠিক পাশেই যেখানে দেবীর মূর্তি তৈরি হয়। এখানকার প্যান্ডেলগুলিতে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প এবং আধুনিকতার এক চমৎকার মেলবন্ধন দেখা যায়। শিল্পীরা হাতে তৈরি প্রতিমার মধ্য দিয়ে তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করেন এবং অনেক সময় এই কুমোরটুলির প্রতিমা বিদেশেও পাঠানো হয়।

এছাড়াও আরও অনেক বিখ্যাত প্যান্ডেল যেমন দেশপ্রিয় পার্ক, একডালিয়া এভারগ্রিন, বাদামতলা আষাঢ় সংঘ, হতিবাগান সর্বজনীন এবং মুদিয়ালি ক্লাব তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় দর্শকদের মন জয় করে। প্রতিটি প্যান্ডেলই তার অনন্য থিম, শিল্পকর্ম এবং পরিবেশ দিয়ে এক বিশেষ বার্তা বহন করে।

কলকাতার একটি থিমভিত্তিক দুর্গাপূজা প্যান্ডেলের বাইরের দৃশ্য
কলকাতার একটি থিমভিত্তিক প্যান্ডেলের অসাধারণ শিল্পকর্ম।

দুর্গাপূজার সাংস্কৃতিক প্রভাব

দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ফ্যাশন এবং অর্থনীতির এক বিশাল আয়োজন। এই সময়ে শহরজুড়ে নতুন নতুন পোশাক, খাদ্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি দেখা যায়।

  • শিল্পকলা ও কারুকার্য: প্যান্ডেল নির্মাণে এবং প্রতিমা গড়ায় শিল্পীরা তাদের অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা বছরের পর বছর ধরে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, যেখানে মাটি থেকে জীবন্ত রূপে দেবীর সৃষ্টি হয়।
  • ফ্যাশন ও কেনাকাটা: পূজার সময় বাঙালিরা নতুন পোশাকে সেজে ওঠে। শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজের দোকানে উপচে পড়ে ভিড়। এই সময় অর্থনীতিতে এক বিশাল চাঙ্গা ভাব দেখা যায়।
  • খাদ্য: পূজা মানেই সুস্বাদু খাবার। ফুচকা থেকে বিরিয়ানি, লুচি-আলুর দম থেকে মিষ্টি – শহরের প্রতিটি রেস্তোরাঁ ও স্ট্রিট ফুডের দোকানে থাকে উপচে পড়া ভিড়।
  • সঙ্গীত ও বিনোদন: প্যান্ডেলগুলিতে নানান ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্য এবং নাটক আয়োজিত হয়, যা উৎসবের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
  • সম্প্রদায়গত সংহতি: এই উৎসব মানুষকে একত্রিত করে। পাড়ার প্রতিটি মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, যা সামাজিক বন্ধনকে আরও মজবুত করে।

দুর্গাপূজার সময়সূচী ও প্রস্তুতি (২০২৫)

শারদীয় দুর্গাপূজা সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে পালিত হয়। মহালয়ার মাধ্যমে দেবীপক্ষের সূচনা হয় এবং এরপর ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে চলে মূল উৎসব। ২০২৫ সালের দুর্গাপূজার সম্ভাব্য তারিখগুলি নিচে দেওয়া হলো:

তিথি তারিখ (২০২৫) গুরুত্ব
মহালয়া ২১ সেপ্টেম্বর দেবীপক্ষের সূচনা, পিতৃতর্পণ
মহাষষ্ঠী ২৮ সেপ্টেম্বর কল্পারম্ভ, দেবীর মূর্তিতে চোখ আঁকা, বোধন ও আমন্ত্রণ
মহাসপ্তমী ২৯ সেপ্টেম্বর নবপত্রিকা স্থাপন, মহাস্নান
মহাষ্টমী ৩০ সেপ্টেম্বর কুমারী পূজা, সন্ধিপূজা (অষ্টমী ও নবমীর সংযোগকালে)
মহানবমী ১ অক্টোবর নবমী পূজা, হোম ও যজ্ঞ
বিজয়া দশমী ২ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জন, শুভ বিজয়া ও সিঁদুর খেলা

এই দিনগুলিতে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, যেমন কুমারী পূজা, যেখানে কুমারী মেয়েদের দেবী রূপে পূজা করা হয়, এবং সন্ধিপূজা, যা মহাষ্টমীর শেষ ও মহানবমীর শুরুর সংযোগকালে অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়া দশমীর দিনে দেবীকে বিদায় জানানো হয় প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে এবং এরপর শুরু হয় বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় ও মিষ্টিমুখের পালা।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

দুর্গাপূজা কেন পালিত হয়?

দুর্গাপূজা মূলত দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধ করে পৃথিবীর অশুভ শক্তি বিনাশ এবং শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে পালিত হয়। এটি নারীশক্তির জয় এবং সকল অশুভ শক্তির বিনাশের উৎসব। এছাড়াও এটি ফসল কাটা এবং পুনর্মিলনের এক আনন্দঘন উপলক্ষ।

কলকাতায় কোন পূজা মণ্ডপগুলি সবচেয়ে বিখ্যাত?

কলকাতায় অসংখ্য বিখ্যাত পূজা মণ্ডপ রয়েছে। এর মধ্যে শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব, কলেজ স্কোয়ার, সুরুচি সংঘ, দেশপ্রিয় পার্ক, একডালিয়া এভারগ্রিন, বাদামতলা আষাঢ় সংঘ, হাতিবাগান সর্বজনীন, এবং মুদিয়ালি ক্লাব অন্যতম জনপ্রিয়। এই মণ্ডপগুলি তাদের থিম, শিল্পকর্ম এবং জমকালো সজ্জার জন্য সুপরিচিত।

ইউনেস্কো কবে দুর্গাপূজাকে স্বীকৃতি দেয়?

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার দুর্গাপূজাকে ‘মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ (Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি দুর্গাপূজার বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে তুলে ধরে।

উপসংহার

কলকাতার দুর্গাপূজা কেবল একটি উৎসবের চেয়েও বেশি কিছু – এটি একটি অভিজ্ঞতা, একটি আবেগ, যা প্রতিটি বাঙালির মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়। এর ঐতিহ্য, শিল্পকলা, এবং সম্প্রদায়গত সংহতি একে truly অবিস্মরণীয় করে তোলে। প্রতি বছর এই উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়, আমাদের সংস্কৃতি আর আমাদের একতার কথা।

Leave a Comment