কলকাতা, যার আরেক নাম ‘সিটি অফ জয়’ বা আনন্দের শহর, তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি আর শিল্পকলার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের মতো পরিচিত স্থানগুলো পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এই শহরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে এমন কিছু গুপ্তধন, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। এই অপ্রচলিত স্থানগুলো কলকাতার এক অন্যরকম দিক তুলে ধরে, যেখানে গেলে আপনি অনুভব করতে পারবেন শহরের আসল স্পন্দন। আসুন, আজ আমরা কলকাতার এমনই কিছু কম পরিচিত কিন্তু দারুণ আকর্ষণীয় স্থানের গভীরে ডুব দিই!
কলকাতার লুকানো রত্নগুলি কী কী?
কলকাতা মানেই শুধু ব্যস্ত রাস্তা আর ট্রামের টুংটাং শব্দ নয়। কলকাতা মানে ইতিহাসের পরত, শিল্পকলার ছোঁয়া, আর গল্প ভরা প্রতিটি অলিগলি। এই শহর তার বুকে ধরে রেখেছে এমন কিছু অসাধারণ স্থান, যা সাধারণ পর্যটকদের ভিড় থেকে দূরে, শান্ত আর নিজেদের অনন্যতায় উজ্জ্বল। চলুন, তেমনই কিছু গুপ্তধনের সন্ধান করি:
মল্লিক ঘাট ফুল বাজার: রঙের উৎসব
হাওড়া ব্রিজের নিচে অবস্থিত মল্লিক ঘাট ফুল বাজার কলকাতার এক অন্যতম প্রাণবন্ত স্থান। ভোরবেলা থেকেই এই বাজার হাজার হাজার ফুলের গন্ধে আর বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে। গাঁদা, গোলাপ, পদ্ম, রজনীগন্ধা – নানা রঙের আর জাতের ফুলে ভরে থাকে গোটা এলাকা। ভোরের আলোয় যখন হাওড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে গঙ্গাবক্ষে সূর্যের প্রথম রশ্মি পড়ে, তখন এই বাজারের দৃশ্য মন মুগ্ধ করে তোলে। ফটোগ্রাফারদের জন্য এটি এক স্বর্গরাজ্য, যেখানে আপনি কলকাতার দৈনন্দিন জীবনের এক অন্যরকম ছবি দেখতে পাবেন। শুধু ফুল কেনাবেচাই নয়, এখানে বসে গঙ্গা নদীর শান্ত রূপ আর হাওড়া ব্রিজের বিশালতা উপভোগ করাও এক দারুণ অভিজ্ঞতা।

সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান: ইতিহাসের নীরব সাক্ষী
পার্ক স্ট্রিটের ব্যস্ততার মাঝে লুকিয়ে আছে এক অন্যরকম শান্তি আর ইতিহাসের আবেশ, যার নাম সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান। ১৭৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কবরস্থানটি ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহত্তম খ্রিস্টান কবরস্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে আপনি দেখতে পাবেন বিভিন্ন ইউরোপীয়দের সমাধি, যার স্থাপত্যশৈলীতে গথিক, ইন্দো-সারাসেনিক, রোমান ডোরিক এবং এমনকি মিশরের পিরামিড স্টাইলেরও প্রভাব রয়েছে। বড় বড় পাথরের তৈরি স্মৃতিস্তম্ভ আর লতাগুল্মে ঢাকা প্রাচীন সমাধিগুলো এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। স্যার উইলিয়াম জোনস এবং হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের শেষ আশ্রয়স্থল এটি। যারা ইতিহাস ভালোবাসেন বা নিরালায় একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা পেতে চান, তাদের জন্য এই স্থানটি দারুণ আকর্ষণীয় হতে পারে।

অমিতাভ বচ্চন মন্দির: এক অভিনেতার প্রতি শ্রদ্ধা
আপনি যদি বিগ-বি-র ভক্ত হন, তবে কলকাতার কুষ্টিয়ায় অবস্থিত এই মন্দিরটি আপনাকে অবাক করবেই! এটি সম্ভবত ভারতের একমাত্র মন্দির যা একজন জীবন্ত অভিনেতার প্রতি উৎসর্গীকৃত। অমিতাভ বচ্চনের প্রতি ভক্তদের অপার ভালোবাসার নিদর্শন এই মন্দির। এখানে তাঁর জুতোজোড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার ও ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ভক্তরা এখানে আরতি করে এবং তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রার্থনা করে। এই মন্দিরটি নিঃসন্দেহে কলকাতার সবচেয়ে quirky এবং কম পরিচিত স্থানগুলির মধ্যে একটি, যা বলিউড প্রেমীদের জন্য এক অন্যরকম আকর্ষণ।
মায়ের ঘাট, বাগবাজার: শান্তির আশ্রয়
বাগবাজারের মায়ের ঘাট হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি শান্ত ও পবিত্র স্থান, যা শ্রীমা সারদা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত। কথিত আছে, শ্রীমা সারদা দেবী এই ঘাটে স্নান করতে আসতেন। ঘাটের পাশেই রয়েছে তাঁর সুন্দর একটি মূর্তি। ব্যস্ত শহরের কোলাহল থেকে দূরে, এই ঘাটে এসে আপনি এক অন্যরকম মানসিক শান্তি অনুভব করবেন। এখানকার শান্ত পরিবেশ আর গঙ্গা নদীর মৃদু স্রোতের শব্দ মনকে শান্ত করে তোলে। সন্ধ্যায় আরতির সময় এই স্থানটির আধ্যাত্মিক পরিবেশ আরও গভীর হয়। যারা কলকাতার আধ্যাত্মিক দিক এবং শান্ত পরিবেশের অভিজ্ঞতা পেতে চান, তাদের জন্য মায়ের ঘাট একটি দারুণ গন্তব্য।

ক্যালকাটা টাউন হল: ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের নিদর্শন
১৮১৩ সালে নির্মিত ক্যালকাটা টাউন হল ব্রিটিশ স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। রোমান ডোরিক শৈলীতে তৈরি এই ভবনটি একসময় ব্রিটিশ সমাজের বিভিন্ন সামাজিক সমাবেশের কেন্দ্র ছিল। বর্তমানে এটি একটি স্থানীয় ইতিহাস জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে কলকাতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখতে পাওয়া যায়। এই হলের বিশাল স্তম্ভ, উঁচু সিলিং এবং ঐতিহাসিক গ্যালারিগুলো আপনাকে ঔপনিবেশিক যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মতো জনপ্রিয় না হলেও, ক্যালকাটা টাউন হল তার নিজস্ব ইতিহাসে আর স্থাপত্যের সৌন্দর্যে কম কিছু নয়। এটি শহর কলকাতার এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী ভবন, যা তার গল্প নিয়ে নীরব দাঁড়িয়ে আছে।
কম পরিচিত স্থানগুলির তুলনামূলক চিত্র
কলকাতার এই অপ্রচলিত স্থানগুলি পর্যটকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়। তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক:
| স্থান | ধরণ | বিশেষত্ব | পরিদর্শনের সেরা সময় | প্রবেশ মূল্য (ভারতীয়দের জন্য) | গুগল রেটিং |
|---|---|---|---|---|---|
| মল্লিক ঘাট ফুল বাজার | বাজার/আকর্ষণ | হাওড়া ব্রিজের নিচে প্রাণবন্ত ফুলের বাজার | ভোরবেলা | বিনামূল্যে | ৪.৩ (২৩২৯ রিভিউ) |
| সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান | ঐতিহাসিক কবরস্থান | ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, প্রাচীন সমাধি | সকাল ১০টা – বিকাল ৫টা | ₹২০-₹২৫ (ক্যামেরাসহ অতিরিক্ত) | ৪.৪ (১৬৬৩ রিভিউ) |
| অমিতাভ বচ্চন মন্দির | মন্দির/ফ্যান ক্লাব | জীবন্ত অভিনেতার প্রতি উৎসর্গীকৃত বিরল মন্দির | সকাল ১০টা – রাত ১০টা | বিনামূল্যে | ৪.২ (২৪৬ রিভিউ) |
| মায়ের ঘাট, বাগবাজার | ঐতিহাসিক ঘাট/আধ্যাত্মিক স্থান | শ্রীমা সারদা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত শান্ত ঘাট | যে কোনো সময়, বিশেষত সন্ধ্যায় | বিনামূল্যে | ৪.৬ (৬৪৪৬ রিভিউ) |
| ক্যালকাটা টাউন হল | ঐতিহাসিক ভবন/জাদুঘর | রোমান ডোরিক স্থাপত্য, স্থানীয় ইতিহাস | সকাল ১০টা – বিকাল ৫টা (মঙ্গল-রবি) | ₹১০ (সপ্তাহে), ₹১৫ (সপ্তাহান্তে) | ৪.৪ (৬৬৯ রিভিউ) |
এই স্থানগুলি পরিদর্শনের টিপস
- সঠিক সময় নির্বাচন: মল্লিক ঘাট ফুল বাজারের প্রাণবন্ততা অনুভব করতে চাইলে খুব ভোরে যান। অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলির জন্য সকাল বা বিকেলের শান্ত সময়গুলি সেরা, যখন ভিড় কম থাকে।
- যাতায়াত: কলকাতা মেট্রো বা লোকাল বাস ও ট্যাক্সি এই স্থানগুলিতে পৌঁছানোর জন্য সুবিধাজনক। কিছু স্থানের জন্য হাঁটাচলার প্রয়োজন হতে পারে, তাই আরামদায়ক জুতো পরা আবশ্যক।
- স্থানীয় সংস্কৃতিকে সম্মান: মায়ের ঘাটের মতো আধ্যাত্মিক স্থানগুলিতে স্থানীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতিকে সম্মান করুন। কবরস্থানে শান্ত পরিবেশ বজায় রাখুন।
- ফটোগ্রাফি: মল্লিক ঘাট ফুল বাজার এবং মায়ের ঘাটে অবাধে ছবি তোলা গেলেও, সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান এবং ক্যালকাটা টাউন হলে ফটোগ্রাফির জন্য কিছু নিয়মাবলী ও অতিরিক্ত চার্জ থাকতে পারে। অমিতাভ বচ্চন মন্দিরে ছবি তোলার আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে পারেন।
- পর্যবেক্ষণ ও অন্বেষণ: কেবল ছবি তোলার জন্য নয়, প্রতিটি স্থানের ইতিহাস, স্থাপত্য এবং পরিবেশকে মনোযোগ সহকারে উপভোগ করুন। এই স্থানগুলির প্রতিটিই এক একটি গল্প বলে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
এই কম পরিচিত স্থানগুলি কি নিরাপদ?
হ্যাঁ, উপরে উল্লিখিত প্রতিটি স্থানই পর্যটকদের জন্য সাধারণত নিরাপদ। তবে, যে কোনো জনবহুল এলাকার মতোই নিজের মূল্যবান জিনিসপত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। রাতে মল্লিক ঘাট বা মায়ের ঘাটের মতো riverside এলাকায় একা যাওয়া এড়িয়ে চলা ভালো, যদিও সেগুলো ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে।
এই স্থানগুলিতে পৌঁছানোর জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা আছে কি?
অবশ্যই! কলকাতা শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। এই প্রতিটি স্থানেই বাস, ট্যাক্সি, অটো রিকশা বা মেট্রো রেলের মাধ্যমে সহজেই পৌঁছানো যায়। পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশন সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান এবং ক্যালকাটা টাউন হলের কাছাকাছি অবস্থিত।
পরিবারের সাথে এই স্থানগুলি পরিদর্শন করা কি উপযুক্ত?
বেশিরভাগ স্থানই পরিবারের সাথে পরিদর্শনের জন্য উপযুক্ত। মল্লিক ঘাট ফুল বাজার এবং মায়ের ঘাটের মতো স্থানগুলি শিশুদের জন্যও আনন্দদায়ক হতে পারে, তবে সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থানের শান্ত ও গম্ভীর পরিবেশ ছোট শিশুদের জন্য কিছুটা অন্যরকম মনে হতে পারে। অমিতাভ বচ্চন মন্দির বলিউডপ্রেমী পরিবারের জন্য একটি মজার অভিজ্ঞতা হতে পারে।
কলকাতা কেবল তার প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই শহর তার অন্তরে ধারণ করে আছে অসংখ্য গল্প, ঐতিহ্য আর অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্যের ভান্ডার। যারা শহরের প্রচলিত ভিড় এড়িয়ে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য কলকাতার এই গুপ্তধনগুলি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা এনে দেবে। পরেরবার যখন কলকাতা যাবেন, তখন এই অপ্রচলিত স্থানগুলিতে গিয়ে শহরের এক নতুন দিক অন্বেষণ করতে ভুলবেন না। আপনার কলকাতা ভ্রমণ হোক আনন্দময় ও স্মৃতিময়!